খুচরো ব্যবসার বাজারে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (ফরেন
ডিরেক্ট ইনভেশমেন্ট বা এফ ডি আই) এলে কার কতটা লাভ, কার কতটা ক্ষতি তাই নিয়ে এখন
প্রবল আলোচনা ও বিতর্ক চলছে সমাজ অর্থনীতি রাজনীতির দুনিয়ায়। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন
ইউ পি এ সরকার তার দ্বিতীয় দফার শাসনে এমনকী অনেক শরিকের আপত্তি ও রঙ বেরঙের
বিরোধীদের তীব্র বিরোধিতা স্বত্ত্বেও কোমর বেঁধে নেমেছেন একগুচ্ছ আর্থিক সংস্কার
সম্পন্ন করবেন বলে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত সম্ভবত খুচরো ব্যবসায় এফ ডি আই
সংক্রান্ত বিষয়টি। কারণটা স্পষ্ট। প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষ মিলিয়ে দেশের মধ্যে সবচেয়ে
বেশি মানুষকে প্রভাবিত করতে সক্ষম এই প্রস্তাবিত নীতি পরিবর্তন। খুচরো ব্যবসা
সংক্রান্ত বিতর্কে ঢোকার আগে এই ব্যবসা ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ের দিকে
প্রথমে একবার নজর ফেলা যাক।
খুচরো ব্যবসার বর্তমান চালচিত্র সংক্রান্ত কিছু তথ্য :-
·
সাড়ে চারশো
বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৫ লক্ষ কোটি টাকা) মূল্যের ভারতীয় খুচরো ব্যবসা দেশের জিডিপির
প্রায় ১৪ শতাংশ, মোট পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম।
·
খুচরো ব্যবসা চার
কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের উপায়, কৃষির পরে ভারতে এটিই প্রধান জীবিকার
ক্ষেত্র।
·
সাম্প্রতিককাল
পর্যন্ত খুচরো ব্যবসার অসংগঠিত ধরণটাই ছিল প্রায় সর্বাংশ, ৯৮ শতাংশ। সংগঠিত খুচরো
ব্যবসা ছিল মাত্র দু শতাংশ।
·
প্রত্যক্ষ বিদেশি
বিনিয়োগ আসার আগেই রিলায়েন্স, টাটা, ভারতী, গোয়েংকার মত দেশীয় একচেটিয়া কারবারিরা
গত কয়েক বছরে নেমে পড়েছে খুচরো ব্যবসায়।
·
১৯৯৯ এ কর্পোরেট
নিয়ন্ত্রিত খুচরো ব্যবসার পরিমাণ ছিল ২৫০০০ কোটি টাকা, ২০০৫ এ এটা ৩৫০০০ কোটি
টাকায় পৌঁছয়।
·
সংগঠিত খুচরো
ব্যবসা ৫ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান ঘটায়, অসংগঠিত খুচরো ব্যবসা প্রায় ৪ কোটি
মানুষের রুজিরুটির পথ।
খুচরো ব্যবসায়
প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এলে লাভের দিকটিই প্রধান, এটা যারা বলছেন, তাদের
যুক্তিগুলো প্রথমে দেখা যাক –
যেসব যুক্তি রাখা হচ্ছে খুচরো ব্যবসায় একচেটিয়া বিদেশি পুঁজির স্বপক্ষে
·
নতুন বিনিয়োগকারীরা যে পুঁজি লগ্নী করবেন, তা নতুন কর্মসংস্থানের জন্ম দেবে।
·
চাষীরা সরাসরি খুচরো বিক্রেতাদের কাছে ফসল বেচবেন। মধ্যস্তরীয় দালাল চক্রের অবসান ঘটবে। চাষীরা ফসলের বেশি দাম পাবেন, ক্রেতারাও কম দামে কৃষিপণ্য কিনতে পারবেন।
·
উন্নত পরিষেবা ও প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রেতার আগ্রহ বাড়িয়ে ব্যবসার সীমানা ও সেইসূত্রে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সহায়ক হবে।
·
পচনশীল কৃষিপণ্য বিক্রেতাদের লাভ হবে সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে এসবের উৎপাদকেরা বিক্রয় মূল্যের পনেরো শতাংশের বেশি পান না, সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় খুব কম দামে তা বেচে দিতে হয়। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।
·
খাদ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিকাঠামোগত ব্যয় দরকার, বাজেট ঘাটতি ভারাক্রান্ত ভারতীয় সরকার তা করতে পারবে না। কিন্তু বিপুল শস্য অপচয়ের ঘাটতি থেকে বাঁচতে হিমঘর ইত্যাদি পরিকাঠামো নির্মাণ জরুরী। বিদেশী লগ্নি এই কাজটি করবে।
·
খুচরো ব্যবসায় বিদেশী বিনিয়োগের বিভিন্ন পদক্ষেপের ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
এক এক করে দাবিগুলি দেশ বিদেশের ব্যবসায়িক গতি
প্রকৃতি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যের আলোতে বিচার করা যাক। প্রথমেই আসা যাক
কর্মসংস্থানগত দাবীর ক্ষেত্রে।
কর্মসংস্থান ও খুচরো ব্যবসায় এফ ডি আই :-
এই প্রস্তাবিত সংস্কার শেষপর্যন্ত রূপায়িত হলে যে সমস্ত অতিকায় বহুজাতিক
দৈত্যরা আসতে চলেছে খুচরো ব্যবসার দুনিয়ায়, তাদের আকৃতি প্রকৃতির সাথে মূলত
অসংগঠিত প্রকৃতির ভারতীয় খুচরো ব্যবসার তুলনা করলেই বোঝা যাবে এটা একটা অসম লড়াই
হতে যাচ্ছে, যা ভারতীয় খুচরো ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশকেই বিলীন হওয়ার দিকে ঠেলে
দেবে।
কারা আসতে চলেছে ? তাদের সাথে ভারতীয় খুচরো ব্যবসার তুলনা
যারা খুচরো
ব্যবসায় আসতে চলেছে তাদের মধ্যে আছে ওয়ালমার্ট, ক্যারিফোর, টেসকো, মেট্রো, ক্রুগার
ইত্যাদি। আমরা সবচেয়ে বিখ্যাত ওয়ালমার্ট এর ব্যবসার পরিমাণের একটা খতিয়ান ভারতীয়
খুচরো ব্যবসার প্রতিতুলনায় দেখতে পারি।
·
ওয়ালমার্ট
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রিটেল চেন। তার ব্যবসার মোট পরিমাণ ২০০৪ সালে ছিল ২৫৬০০ কোটি
ডলার অর্থাৎ প্রায় পনেরো লক্ষ কোটি টাকা।
·
গোটা পৃথিবীতে
তার প্রায় পাঁচ হাজার দোকান, যার এক একটির গড় আয়তন ৮৫০০০ হাজার বর্গফুট।
·
যে ১৪ লক্ষ কর্মী
এই হাজার পাঁচেক দোকানে কাজ করেন তাদের মাথাপিছু হিসাবে ওয়ালমার্ট এর ব্যবসা বছরে
১ লক্ষ ৭৫ হাজার ডলার বা ৯০ লক্ষ টাকা।
·
এর তুলনায় ভারতীয় খুচরো ব্যবসায়ীদের বার্ষিক গড়
ব্যবসা ১ লক্ষ ৮ হাজার টাকা।
·
আমাদের দেশে ১
কোটি ২০ লক্ষ দোকানের মাত্র চার শতাংশের আয়তন পাঁচশো বর্গফুটের বেশি।
·
৭ লক্ষ ৩৫ হাজার
কোটি টাকার অসংগঠিত খুচরো ব্যবসা থেকে জীবিকা নির্বাহ হয় ৩ কোটি ৯৫ লক্ষ মানুষের।
বোঝা শক্ত নয় বহুজাতিক
বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে ভারতীয় অসংগঠিত খুচরো ব্যবসার কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা কার্যত
অসম্ভব। এই সংক্রান্ত একটি সমীক্ষার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। শপিং মল ছোট খুচরো
ব্যবসায় কেমন প্রভাব ফেলে সে সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল মুম্বাইতে। এই
সমীক্ষার রিপোর্ট সমীক্ষকদের পক্ষ থেকে অনুরাধা কলহন তুলে ধরে জানিয়েছেন আনাজপাতি, ফল, শাকসব্জি, প্রক্রিয়াকরণ করা খাবার, পোষাক
আশাক, জুতো, বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সমস্ত ধরণের জিনিসের
বিক্রেতাদের ৫০% ই শপিং মলের প্রভাবে ভালোরকম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। মাত্র ১৪%
বিক্রেতা প্রতিযোগিতায় থাকতে পারছেন।[1]
মনে রাখা দরকার এই সমীক্ষাটি ছোট দোকানের ওপর অতি বৃহৎ বহুজাতিক ওয়াল মার্ট বা
মেট্রোর মত হাইপার মার্কেট এর চেয়ে অনেক ছোট মাপ ও ক্ষমতার শপিং মলগুলির প্রভাব
নিয়ে করা। নিশ্চিতভাবেই ওয়াল মার্ট ইত্যাদির আগমন এই প্রভাবকে অনেক বেশি ব্যাপ্ত
করে তুলবে।
খুচরো ব্যবসা
কৃষির পরে ভারতের সবচেয়ে বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের জায়গা। ভারতীয় সমাজে এই পেশা
অনেক ক্ষেত্রেই বেঁচে থাকার শেষতম উপায়। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার মজুর, বেকার
যুবক, বৃদ্ধিহার হারিয়ে ফেলা কৃষিক্ষেত্রের বাইরে থাকা উদবৃত্ত গ্রামীণ মানুষ
সপরিবার যে খুচরো ব্যবসাকে অবলম্বন করে টিঁকে থাকেন তাকে সামান্যতম আঘাত করার অর্থ
দেশে অনাহার মৃত্যুমিছিল ও সামাজিক নৈরাজ্যের পথ খুলে দেওয়া। অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ
বাদ দিয়েও মানবিক ও সাংস্কৃতিক সামাজিক দিক থেকে কোটি কোটি মানুষের জীবন জীবিকার
সঙ্গে জড়িয়ে থাকা খুচরো ব্যবসার প্রচলিত রূপটির বিচার হওয়া উচিৎ।
কৃষক ও অন্যান্য উৎপাদকের দৃষ্টিকোণ থেকে খুচরো ব্যবসায় এফ ডি আই :-
খুচরো ব্যবসার পক্ষের প্রচারকদের বড় দাবির জায়গা খুচরো ব্যবসায়ে এফ ডি আই এলে
প্রত্যক্ষ উৎপাদক অর্থাৎ কৃষকদের সমূহ লাভ হবে। কেননা মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়েরাই
কৃষকের লাভের গুড় খেয়ে যায়। বহুজাতিকরা খুচরো ব্যবসায় এলে তারা কৃষকের থেকে সরাসরি
ফসল কিনবেন, ফলে কৃষক ফসলের বেশি দাম পাবেন। ফড়েচক্র লোপ পেলে ক্রেতারাও কম দামে
কৃষিপণ্য পাবেন। একইভাবে বস্ত্র, হস্তশিল্পর ক্ষেত্রেও উৎপাদক ও ক্রেতা উভয়পক্ষই
অনেক লাভবান হবেন। খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পক্ষের উকিলরা এই
দিকটিতে সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন, এমনকী ধনী কৃষকদের একাংশও এই দাবির পক্ষে সওয়াল
করেছেন। এই দাবিটিকে তাই বিভিন্ন তথ্যের সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
সমীক্ষা
রিপোর্টগুলি কি বলছে ?
বহুজাতিকদের নিয়ন্ত্রিত সংগঠিত খুচরো ব্যবসায় উৎপাদকেরা বিক্রিত পণ্যের দামের
ঠিক কতটা অংশ পান সে সংক্রান্ত একটা সমীক্ষা করেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ স্বয়ং।[2]
১৯৮১ সালে করা সেই সমীক্ষার তথ্য থেকে জানা যায় ফিলিপিন্সের কলা উৎপাদকেরা জাপানের
বাজারে বিক্রিত পণ্যের দামের ১৭ শতাংশ পেয়ে থাকেন। টাটকা আনারসের দাম হিসেবে
থাইল্যাণ্ডের রপ্তানিকারকেরা আমেরিকার বাজারে পেয়েছেন বিক্রিত পণ্যের ৩৫ শতাংশ। এই
৩৫ শতাংশের মধ্যে উৎপাদক চাষীদের প্রাপ্য অর্থ ছিল মাত্র ১০ শতাংশ। বিশ্বব্যাঙ্কের
১৯৯৪ সালের ‘বিশ্বের আর্থিক সঙ্কট এবং উন্নয়নশীল দেশ’ সংক্রান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী
তুলো উৎপাদকেরা শেষহাতে বিক্রিত মূল্যের মাত্র ৪ থেকে ৮ শতাংশ পান। তামাকের
ক্ষেত্রে এটা ৬ শতাংশ, কলার ক্ষেত্রে ১৪ শতাংশ, পাটজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে ১১ থেকে
২৪ শতাংশ, কফির ক্ষেত্রে ১২ থেকে ২৫ শতাংশ, প্যাকেট চায়ের ক্ষেত্রে ইংলন্ডে ৪৭ শতাংশ
হলেও আমেরিকার টি ব্যাগের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ। কিন্তু এই শতাংশ মাত্রার হিসেবকেও
অনেকে বেশি করে ধরা বলে মনে করেছেন। মিচেল চোসুদোভস্কির হিসাবমতে[3]
এই সময়পর্বে উত্তর আমেরিকার কফির বাজারে বিক্রিত দামের মাত্র ৪ শতাংশ উৎপাদকদের
পকেটে গেছে। সাম্প্রতিক সময়কালে অক্সফ্যাম এর করা একটি সমীক্ষা রিপোর্ট[4]
দেখায় যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদকের লভ্যাংশ আরো কমেছে।
Sector
|
%
share of income
|
Farm
labour
|
5
|
Farm
income
|
4
|
Supermarket
|
42
|
Importer's
commission and duty
|
7
|
U.K.
handling
|
7
|
Shipping
|
12
|
Transport
and customs
|
6
|
Farm
inputs and packaging
|
17
|
Source:
Oxfam (2004)
|
যারা বলছেন খুচরো ব্যবসায়ে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এলে কৃষক তথা উৎপাদকদের
প্রভূত লাভ হবে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এইসব সমীক্ষাজাত বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে
চাইছেন।
কম দামে পণ্য ? না উৎপাদকের (কৃষক/শ্রমিক) লাগামছাড়া শোষণ ? :-
অক্সফ্যাম তার সমীক্ষায় এটাও দেখিয়েছে ঠিক কি কি কারণে গোটা ব্যবসায় উৎপাদকদের
লভ্যাংশ এত কম থাকে আর সুপারমার্কেট চেনগুলি লাভের সিংহভাগ নিয়ে যায়। বিশ্বের
বিভিন্ন বাজার জমি শিল্প কারখানায় ছড়িয়ে থাকা নিয়ন্ত্রণের দৌলতে দৈত্যকার এইসব
বহুজাতিক কোম্পানীগুলির দরাদরির শক্তি স্বাভাবিকভাবেই মারাত্মক। নতুন প্রযুক্তি,
উদার বাণিজ্যনীতি, পুঁজির অনায়াস গতির ওপর ভর করে এই অতিকায় শক্তিগুলি বিশ্বের
কোণায় কোণায় ক্রমশ নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে আর সেইসঙ্গে ব্যবসায়িক
শর্তগুলিকে বেশি বেশি করে নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে
তুলছে। একচেটিয়া আধিপত্যের সুযোগে তারা বদলে দিচ্ছে ব্যবসার যাবতীয় ধরণ, কঠোর
নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে উৎপাদনের সময়সীমা, মর্জিমত মান, দাম, পণ্য বাতিলের অধিকারের
ওপর। গোটা ব্যবসা পদ্ধতির সবচেয়ে বড় আঘাতটা এসে পড়ছে দুর্বলতর গ্রন্থি উৎপাদন
প্রক্রিয়ায় জড়িত শ্রমিকের ওপর। রপ্তানির চূড়ান্ত অনিশ্চিত শর্তের পরিমাপে শ্রমিক
নিয়োগ করা হচ্ছে, যাদের ভাগ্যে থাকছে নিয়োগের সাময়িক চুক্তি, যখন তখন ছাঁটাই, কম
মজুরীতে দীর্ঘক্ষণ কাজের চাপ, দ্রুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা, অনিশ্চিত বেতন। আর
ক্ষোভ বিক্ষোভকে সীমায়িত রাখার জন্য উপেক্ষা করা হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার।
অতিকায় সাপ্লাই চেনগুলোতে মাল সরবরাহকারী তৃতীয় বিশ্বের কারখানাগুলো সুরক্ষা
সংক্রান্ত নিয়ম নীতিরও কোনও ধার ধারে না, কারণ অত্যন্ত সুলভে মাল সরবরাহের জন্য
চুক্তিবদ্ধ থাকায় সুরক্ষা বাবদ ব্যয়কে তারা বিলাসিতা হিসেবেই গণ্য করে।
বস্তুতপক্ষে বন্টনকারীই এখানে উৎপাদককে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। সুরক্ষার
অভাবে কারখানাগুলোতে প্রায়ই ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। সাম্প্রতিককালে আমরা বাংলাদেশের
বস্ত্র কারখানায় শতাধিক মানুষের আগুনে পুড়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা ভাবতে পারি। সেখানে
কোনও সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না, অত্যন্ত কম মজুরীতে উদয়াস্ত পরিশ্রমকারী শ্রমিকরা
অতর্কিতে আগুনে বেরোনোর পথ রুদ্ধ হয়ে মারা গেল শুধু না, আগুন লাগার পরেও জনৈক
ম্যানেজার নীচ তলায় আগুন লেগেছে বলে ওপর তলায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার ফরমান দেন, নীচে
নামার কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে রাখা হয়। অবিশ্বাস্য হলেও এধরণের পাশবিক আচরণের কারণ
হিসেবে কাজ করে মাল রপ্তানীর নির্দিষ্ট ‘ডেটলাইন’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বাংলাদেশের ওই
বস্ত্র কারখানা ওয়ালমার্টের জন্য পোষাক সরবরাহ করে থাকে। ওয়ালমার্টের মত রিটেল
জায়ান্টদের তথাকথিত কম দামে পণ্য বিক্রির পেছনে থাকে ব্যাপকতম মাত্রায় শ্রমিক
শোষণ, যা জবরদস্তি উৎপাদন ব্যয়কে কমিয়ে রাখে। আর এটা তারা সম্পন্ন করে অতিকায়
পুঁজির জোরে। নিজেদের লভ্যাংশ কম রাখে বলে ওয়ালমার্ট ইত্যাদিদের বিক্রি করা
দ্রব্যের দাম কম হয়ে থাকে, এমনটা আদৌ নয়। বরং বাস্তব চিত্র ঠিক এর বিপরীত। শ্রমিক
সরবরাহকারী ও ওয়ালমার্টের লাভের হারের অনুপাতটা ঠিক কেমন ? বাংলাদেশ এর
বস্ত্রশিল্প ও আমেরিকান বাজারের সংযোগ নিয়ে করা একটি গবেষণায়[5]
চোসুদোভস্কি জানিয়েছেন একটি জামা আমেরিকায় ১০০ টাকায় বিক্রি হলে তার মধ্যে ১ টাকা
৭০ পয়সা পায় উৎপাদক শ্রমিক, ১ টাকা পায় সরবরাহকারী আর অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে ৭১
টাকা ৮০ পয়সা পায় মলের বিক্রেতা। যারা ওয়ালমার্ট ধরণের অতিকায় বহুজাতিক সংগঠিত
খুচরো ব্যবসার পক্ষে ওকালতি করছেন তারা দেশের অগণিত খুচরো ব্যবসায়ীর স্বার্থকেই
শুধুমাত্র উপেক্ষা করছেন তাই নয়, কৃষক শ্রমিক সহ যাবতীয় উৎপাদকদের সামনে যে নতুন
শর্ত ও দাদনপ্রথার ভয়াবহতা আসতে চলেছে, তাকেও বুঝতে চাইছেন না। অতিকায় রিটেল চেন
এমন একটা মডেল যেখানে বিপুল পুঁজি সমৃদ্ধ বন্টন ব্যবস্থা উৎপাদক ব্যক্তি বা
সংস্থাকে পুরোপুরি তার শর্তে গ্রাস করে নেয়।
ওয়ালমার্ট
ইত্যাদির ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষা দেবে, এটা কতটা বাস্তব ?
এই প্রসঙ্গে কেউ কেউ রাষ্ট্র প্রদত্ত নিরাপত্তার ধুয়ো তুলছেন, যা প্রয়োজনে
অর্থাৎ ওয়ালমার্ট ইত্যাদির বাড়াবাড়ি দেখলে ব্যবহার করা হবে। আমদের দেশের বৃহৎ
পুঁজির লুঠতরাজের ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের অনীহা নিতান্ত স্পষ্ট। এমনকী
বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্র, যারা ইতোমধ্যেই খুচরো ব্যবসায় অতিকায় আন্তর্জাতিক পুঁজিকে
ছড়ি ঘোরানোর ছাড়পত্র দিয়েছে, তারা অভ্যন্তরীণ চাপে পরবর্তীকালে একে নিয়ন্ত্রণ করতে
চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রসঙ্গে থাইল্যাণ্ড সরকারের অভিজ্ঞতা আমরা পর্যালোচনা
করতে পারি। গ্যাট চুক্তির আগেই ১৯৮০ সালে থাই সরকার তার খুচরো ব্যবসার বাজারকে
বিদেশি পুঁজির জন্য খুলে দিয়েছিল। টেসকো, রয়্যাল আহোল্ড, ক্যারিফোর সেখানে ব্যবসা শুরু
করে। একচেটিয়া পুঁজির সাথে অসম প্রতিযোগিতায় স্বাভাবিক নিয়মেই অনেক পুরনো খুচরো
বিক্রেতার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। দেশীয় খুচরো ব্যবসায়ীদের লাগাতার সমালোচনার মুখে
পড়ে সরকার ঘোষণা করল অঞ্চল ভিত্তিকভাবে খুচরো ব্যবসার ওপর বেশ কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ
করা হবে। ২০০২ সালে এই মর্মে খুচরো ব্যবসা আইন চালু করে একচেটিয়া কারবারীদের
নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হল। কিন্তু আন্তর্জাতিক পুঁজি ও তার মুখপাত্র ওয়ার্ল্ড
ট্রেড অর্গানাইজেশন এর চাপে থাইল্যাণ্ড সরকার এই নিয়ন্ত্রণ মুলতুবি রাখতে বাধ্য
হল, কেননা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন গ্যাট চুক্তির ধারা তুলে জানাল সেখানে
অঞ্চল ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণকে ‘ব্যবসা প্রতিবন্ধক’ হিসেবে গণ্য কর হয়েছে। ভারত
রাষ্ট্র তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হলেও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের শ্রেণিচরিত্র কতটা
ওয়ালমার্ট ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করতে যত্নবান হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অধিকন্তু
আশঙ্কা থেকেই যায় এদের নিয়ন্ত্রণের এজেন্ডা নিয়ে কোনও জনপ্রিয় সরকার ক্ষমতায় আসার
পরিস্থিতি তৈরি হলে বা সরকারে এলে এদের অতি বৃহৎ পুঁজি মুনাফা অব্যাহত রাখার
তাগিদে সেই গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বংস করার কাজেই নিয়োজিত হবে। পৃথিবীর
বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করতে একচেটিয়া বিদেশী পুঁজির
অস্তিত্ত্ব আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ – ইত্যাদির মাধ্যমে বারবার সক্রিয়
ভূমিকা নিয়েছে। চিলির আলেন্দে সরকারের অভিজ্ঞতা সকলেরই জানা আছে।
বিদেশী বিনিয়োগের পক্ষে অন্যান্য যুক্তির
একদেশদর্শিতা ও ভ্রান্তিগুলি
·
বিদেশী বিনিয়োগের
পক্ষে ওকালতি করে যে সব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তাতে ধরে নেওয়া হচ্ছে সরকার একটি
জড়ভরত। সংরক্ষণ সংক্রান্ত পরিকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয় দিকটিতেই আসা যাক।
কৃষিনির্ভর ভারতীয় অর্থনীতিতে কৃষি ও শস্য সংরক্ষণ পরিকাঠামো নির্মাণ সরকারের
প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। স্বাধীনতার পর দশ বছরের মতো সময় বাদ দিলে প্রায়
পঞ্চাশ বছর যারা দেশ শাসন করল, তাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতাকেই এই যুক্তি তুলে ধরছে না,
বিদেশী পুঁজিকে নিজের পঙ্গুত্ব ঢাকার সর্বরোগহর ওষুধের জায়গাতেও নিয়ে যাচ্ছে।
·
একদিকে সরকারী
খাদ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাকে জোরদার করা ও অন্যদিকে গণবন্টন ব্যবস্থাকে মজবুত করার সহজ
প্রক্রিয়াতেই ফড়ে সংক্রান্ত সমস্যার সহজ সমাধান তথা কৃষক ও ক্রেতার বিনিময় মূল্যের
মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার পথটি রয়েছে। সরকারী সদিচ্ছা ও কার্যকরিতার অভাবের দিকটিকে
আড়াল করতেই এক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজির অপরিহার্যতার দিকটিকে সামনে আনা হচ্ছে।
খুচরো ব্যবসায় একচেটিয়া বিদেশী
(এমনকী একচেটিয়া দেশী) পুঁজির বিরোধিতার পাশাপাশি দাবী তোলা দরকার হিমঘর ইত্যাদি
পরিকাঠামোগত নির্মাণ ও খাদ্য সংগ্রহ ও বন্টনের ভেঙে পড়া ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রভূত
সরকারী উদ্যোগের। কৃষিকে লাভজনক করার ক্ষেত্রে সার সেচ বীজ বিদ্যুতে সরকারী
সাহায্য বাড়ানোর। সমস্যার মূলকে ছুঁতে তলা থেকে অর্থনৈতিক সংস্কার জরুরী, কিন্তু
দেশের শাসক শ্রেণি ও তাদের ইউ পি এ সরকার নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ চরিতার্থ করতে
একচেটিয়া বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধানের নিদান
দিচ্ছে। যে জঘন্য প্রক্রিয়ায় সংসদে শেষপর্যন্ত খুচরো ব্যবসায়ে এফ ডি আই এর প্রবেশ
সংক্রান্ত বিষয়টি ছাড়পত্র পেল, তা আরেকবার প্রমাণ করল দেশের শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য
বদলানোর লড়াইয়ের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে খুচরো ব্যবসায় এফ ডি আই এর প্রবেশ ও অন্যান্য
সংস্কারের প্রতিরোধ সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সফল রূপায়ণের প্রশ্নটি।
[2] United Nations
Economic and Social Commission for Asia and the Pacific (ESCAP), Transnational Corporations and
Primary Commodity Exports from Asia and the Pacific, 1981.
[3] Michel Chossudovsky, The Globalisation of Poverty:
Impacts of IMF and World Bank Reforms, Indian
edition, 1997
No comments:
Post a Comment