পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের একটা
খ্যাতির কথা বিভিন্ন মহল থেকে প্রায়ই তুলে ধরা হয়। যে দিকগুলি এর প্রশংসকরা তুলে
আনেন তার মধ্যে রয়েছে সেনাবাহিনীর ওপর নির্বাচিত সরকারের ধারাবাহিক আধিপত্য, বিরাট সংখ্যক মানুষের গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়া তথা নির্বাচনে সামিল হওয়া, আইনসভা, বিচারসভা ও প্রশাসনের পারস্পরিক
নিরপেক্ষতা, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি।
এটা ঠিক শুধু এত বিশাল একটা জনসংখ্যাকে
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সামিল করতে পারাই নয়, প্রতিবেশী সমস্ত দেশের মধ্যে প্রায়
একমাত্র উদাহরণ হিসেবে স্বৈরতন্ত্র/সেনাশাসনের বাইরে থেকে নির্বাচিত সরকারের
নিরঙ্কুশ আধিপত্যকে ব্যতিক্রমহীনভাবে চালিয়ে যাওয়া ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম
বলিষ্ঠ দিক। ইউরোপ আমেরিকার মত তুলনামূলক কম জনঘণত্ব ও অধিক শিক্ষার হার সমন্বিত
দেশগুলোর বাইরে এরকম ধারাবাহিক গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত খুব সুলভ নয়, আর সেই বিচারে এই
সাফল্যকে আরো বেশি উজ্জ্বল দেখায়।
ভারতীয় গণতন্ত্রের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়ার অন্যতম মূল বনিয়াদ আইনসভার নির্বাচনে বহু শতাধিক ছোট বড় রাজনৈতিক
শক্তির (এমনকী ব্যক্তিরও নির্দল হিসেবে) অংশগ্রহণ। কেন্দ্রীয় আইনসভা (লোকসভা) ও
রাজ্যের আইনসভাগুলির (বিধানসভা) নির্বাচনে এই বৈশিষ্ট্য ব্যতিক্রমহীনভাবে বছরের পর
বছর নজরে পড়ে।
ভারতীয় গণতন্ত্রের আর একটি স্তম্ভ হিসেবে ধরা
হয় বিচারব্যবস্থা ও তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে। সুপ্রিম কোর্ট, রাজ্যগুলির হাইকোর্ট ও
তার তলার দিকের বিচার ব্যবস্থা কিছু বিতর্ক নিয়েও মূলত নিরপেক্ষতার উদাহরণ হিসেবেই
প্রতিভাত হয়ে আছে। বিভিন্ন স্তরের সরকার ও প্রশাসন বিচার ব্যবস্থার দ্বারা ভৎসিত
হচ্ছে, সংশোধনে বাধ্য হচ্ছে – এটা বেশ নিয়মিত ঘটনা হিসেবে বারবার সামনে আসে।
ভারতে সংবাদ মাধ্যম এর
স্বাধীনতা তার গণতান্ত্রিক শক্তির অন্যতম সোপান ও পরিচায়ক বলে অভিনন্দিত। বিভিন্ন
মত ও দৃষ্টিকোণ নির্ভর বহুসংখ্যক জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যম – যার মধ্যে
বৈদ্যুতিন ও মুদ্রিত উভয়েই বিদ্যমান – সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রর বিভিন্ন ধরণের স্খলন
অবিচার সমস্যাকে সামনে এনে, সমাধানের বহুমতকে তুলে ধরে যেভাবে জনমানস, প্রশাসন ও নীতি
নির্ধারকদের প্রভাবিত করে, তা নিঃসন্দেহে দেশ ও সমাজের বহুস্বরিক গণতন্ত্রের ভিত্তিকে
মজবুত করে।
গণতান্ত্রিক কাঠামোর
এই সমস্ত দিকগুলি বাহ্যত এক শক্তিশালী গণতন্ত্রের চেহারাকে তুলে ধরে। কিন্তু
কাঠামোর এই বাহ্য দিকগুলি প্রকৃত বিচারে কতটা ঘাতসহ, আর এর নাগরিকরা বিবিধ
দৃষ্টিকোণে কতটা সক্ষম (এমপাওয়ারড), গণতন্ত্রের শক্তি দুর্বলতা নির্ধারণে সেটা
অন্যতম প্রধান বিবেচ্য। আর এই বিচার থেকেই উঠে আসে ভারতীয় গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতার
দিকগুলি।
ভারতীয় গণতন্ত্রে বাহ্যত
সকল নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। বিচার পাওয়া, ভোটদানের ও নির্বাচনে
প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার, যে কোন কাজে সুযোগের অধিকার ইত্যাদি। কিন্তু
নিয়মতান্ত্রিক এই অধিকারের আড়ালে রয়েছে বাস্তব জীবনে বৈষম্যের বহুবিধ উদাহরণ। এই
বৈষম্য শ্রেণি, জাত/বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, ভাষা/অঞ্চল – সমস্ত গুরূত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই
পরিব্যাপ্ত। এই বৈষম্যই প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন সুযোগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার
দেওয়ালগুলি তৈরি করে দেয়। গণতন্ত্র সংক্রান্ত সাধারণ আলোচনায় তার প্রত্যেকটির
অনুপুঙ্ক্ষ বিচারের সুযোগ কম, সেটা আলাদা আলাদা আলোচনার পরিসর দাবি করে। বৈষম্যের কয়েকটি
মূল দিক এখানে তুলে আনা যেতে পার, বিশেষত তার কেন্দ্রীয় দিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ও
তার পেছনে সক্রিয় নীতিমালার দিকটি।
শুধু মার্কসবাদীদের
কাছেই নয়, সাধারণভাবে সমাজবিজ্ঞানের প্রায় সব ধারাতেই এটা একটা সাধারণ স্বীকৃত
সত্য যে অর্থনৈতিক অবস্থাই কোনও ব্যক্তির জাগতিক সুখ সুবিধাকে বোঝার প্রধানতম
নিয়ামক। আর এই দিকটির আলোচনা করলে দারিদ্র পীড়িত, অর্থনৈতিক অসাম্য জর্জরিত ভারতের
চেহারাটা বেরিয়ে আসে। একদিকে দুনিয়ার অন্যতম প্রধান ধনীদের দেশ এই ভারত, অন্যদিকে
বিশ্বের বৃহত্তম গরীব মানুষের বাসভূমিও এটি। এই চরম বৈপরীত্য কমে আসার বদলে ক্রমশ
বেড়েই চলেছে, আর গ্রাম শহরের ব্যাপক বেকারত্ম, ছদ্ম/আধা বেকারত্মকে সঙ্গে নিয়ে এই
ক্রমবর্ধমান অসাম্য সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নৈরাজ্যের সম্ভাবনা বাড়িয়েই চলেছে।
আমরা এই লেখায় অসাম্যের পরিসংখ্যানের দিকে এগোতে চাইবো না, কারণ পাঠকের কাছে
বিষয়টি পরিসংখ্যান ব্যাতিরেকেই স্পষ্ট। আর্থিক দুর্দশা বিভিন্ন সঙ্কটকে কীভাবে
বিস্তৃত করে দেয় বা ক্ষমতায়নকে (এমপাওয়ারমেন্ট) কীভাবে সংকুচিত করে দেয়, সে দিকেও
এগোতে না চেয়ে আমরা ভারতের গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত শাসক সরকারগুলির গৃহীত
নীতিমালা ও সেই নীতিমালা নির্মাণের পেছনে লুকিয়ে থাকা কিছু গূঢ় রহস্যের অন্দরমহলে
পৌঁছতে চাইবো, সেই সূত্রেই খোঁজ নিতে চাইবো ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্তরমহলের।
ভারতীয় অর্থনৈতিক
গণতন্ত্রকে গত দু দশকে উদার অর্থনীতির জমানায় পরিকল্পিত ভাবেই চরম বৈষম্যমূলক ও
দেশী বিদেশী কর্পোরেট বান্ধব করে তোলা হচ্ছে। দুর্নীতিকে ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম
বড় বিপদ বলে ইদানীং অনেকেই চিহ্নিত করতে চান। এই প্রসঙ্গে এটা যোগ করা জরুরী আজকের
দিনের প্রধান দুর্নীতিগুলো শাসক দলগুলি গৃহীত নীতিমালার সঙ্গে শুধু অঙ্গাঙ্গী
যুক্তই নয়, তারই গর্ভ থেকে নিঃসৃত।
দেশের মানুষের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে তার
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা বিকাশ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার প্রতি
বিশ্বাসঘাতকতা জনপ্রতিনিধিত্ব মূলক শাসন কাঠামোকে অনেকাংশেই নিয়মতান্ত্রিক ও ফাঁপা
বলে প্রতিপন্ন করছে। আম আদমি দ্বারা নির্বাচিত সরকারগুলি দেশি বিদেশি একচেটিয়া
কর্পোরেট আধিপত্যর কাছে স্বেচ্ছায় মাথা নত করছে, আর সেটা শুধু তার গণতান্ত্রিক
চরিত্র নয়, সময়ে সময়ে তার সার্বভৌম সত্তার প্রতিও প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। উনিশশো
নব্বই পরবর্তী উদার অর্থনীতির জমানায় ‘আমীরপন্থী আমেরিকাপন্থী’ দেশি বিদেশী
কর্পোরেট বান্ধব নীতিমালাগুলি (যা ইউ পি এ ও এন ডি এ জমানার সকল আপাত যুযুধমান
শাসক দলগুলির শাসনে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত) কীভাবে দুর্নীতির ব্যাপক আয়োজনের এক
নতুন মাত্রা তৈরি করেছে এবং নানাসূত্রে ভারতীয় গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তির ওপর আঘাত
হানছে তার পর্যালোচনা করলে ভারতীয় গণতন্ত্রের ফলিত চেহারাটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে
যায়।
৬৪ কোটি টাকার বোফর্স কেলেঙ্কারি একটি সরকারের
পতন ঘটিয়েছিল। আর এখন আমরা প্রায় প্রতিদিনই লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতির ঘটনা
প্রকাশ হতে দেখছি। এটা ঘটনা যে দুর্নীতির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু আরো বড়
কথা হলো আজকের দুর্নীতির চেহারাটাই উদারনৈতিক ও বিশ্বায়িত ভারতরাষ্ট্রের
চেহারাটাকে প্রতিফলিত করছে। বৃহৎ পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সব সময়েই
ভারতরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় ও বহুজাতিক কর্পোরেট
সংস্থা এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি ক্রমবর্ধমান হারে রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে
আরো প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করছে।
ব্যাপারটা এত ব্যাপকভাবে ঘটছে যে প্রশ্ন উঠছে
শাসকশ্রেণির রাজনীতিবিদরা কি কর্পোরেটদের দালাল ? এই প্রসঙ্গে আমরা কিছুদিন আগে
আলোড়ন সৃষ্টিকারী রাডিয়ে টেপ এর কথা ভাবতে পারি। যে টেপ এর কথাবার্তা দেখিয়ে
দিয়েছিল কিভাবে কর্পোরেটরা তাদের ‘লবিইস্ট’ দের মাধ্যমে দেশের শাসননীতিকে প্রভাবিত
করার চেষ্টা করছে। কিভাবে মন্ত্রীদের নিয়োগ, সংসদের আইন পাশ এবং নীতিকে তাদের
স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে রাজনীতি ও কর্পোরেট তহবিল
এর আলিঙ্গন ক্রমশ বেড়েছে। কয়েকবছর আগে বিজেপির প্রমোদ মহাজন এবং সমাজবাদী পার্টির
অমর সিং এর কথা শোনা যেত, যারা তাদের পার্টির জন্য কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক শো
কোটি টাকা তুলে ফেলতে পারেন। এই কর্পোরেট দাক্ষিণ্য নিশ্চিতভাবেই প্রতি দক্ষিণার
শর্তের সাথে যুক্ত। রাডিয়ারা কর্পোরেট লবির হয়ে যে কাজ করে দেন, যেমন এ রাজাকে
টেলিকম মন্ত্রী বানানো, তা পরবর্তী
উপকারের কথা মাথায় রেখেই। কর্পোরেটদের টাকা রাজনীতিবিদের পরিবারকে ঘুষ হিসেবে
দেওয়া হয়, আর সেই ঘুষের কালো টাকা পরিবারের মাধ্যমেই সাদা হয়। কর্পোরেটদের বিপুল
টাকা যে সুবিধাজনক রিপোর্ট বা সুপারিশের জন্যই শুধু কাজে লাগে তা নয়, এ দিয়ে এমনকী
বিচারপতিদেরও প্রভাবিত করা যায়। এই ছবিটা অমর সিং টেপ, প্রমোদ মহাজন ঘটনাবলীতে
নিহিত ছিল এবং রাডিয়া টেপএ তার পরিপূর্ণ চেহারা বেরিয়ে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা
বিভিন্ন আর্থিক এবং আভ্যন্তরীণ নীতি – এস ই জেড আইন, পেটেন্ট আইন, নিউক্লিয়ার
লায়াবিলিটি আইন, বিভিন্ন কালা কানুন, অপারেশন গ্রীন হান্ট প্রভৃতি এবং শিক্ষা ও
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কিছু নীতিমালাও তৈরি হচ্ছে কর্পোরেট স্বার্থের কথা মাথায়
রেখেই।
রাডিয়া টেপের চেয়েও উইকিলিকস এর ফাঁস করা
ঘটনাবলী ভারতীয় গণতন্ত্র ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশের সার্বভৌমত্বকে কড়া প্রশ্নের
মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। চলমান রাজনৈতিক
দুর্নীতির সবচেয়ে বড় প্রমাণ সম্ভবত প্রথম ইউ পি এ সরকারের শেষপর্বে সংসদে
নিউক্লিয়চুক্তির সময় আস্থাভোটে টাকার বিনিময়ে সাংসদদের ভোট কেনাবেচার ঘটনাটি।
উইকিলিকস এর এই সংক্রান্ত কেবল এর প্রকাশ ইউ পি এ সরকারের আস্থাভোটে জয়ের জন্য
সাংসদ কেনাবেচার ব্যাপক অভিযোগটি শেষপর্যন্ত প্রমাণ করে দিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস ও
বিজেপি উভয়দলই উইকিলিকস এর কেবল প্রকাশ এর ঘটনার গুরুত্বকে কমিয়ে দেখাতে সচেষ্ট।
কেন কংগ্রেস নেতারা আমেরিকান কূটনীতিকদের বলতে গেলেন আস্থাভোটে জয়ের জন্য ভোট
কেনার পরিকল্পনার কথা, আর কেনই বা তাদের ট্রাঙ্ক ভর্তি টাকা দেখালেন? এর স্পষ্ট
কারণ একটাই। তাদের আমেরিকি প্রভুদের এটা দেখিয়ে তারা নিশ্চিন্ত করতে চেয়েছিলেন, ইউ
পি এ সরকার আস্থাভোটে জিতে যাতে নিউক্লিয় চুক্তি করতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য
যা যা করণীয় তারা তা করছেন।
শুধু আস্থাভোটের ঘটনাটিই নয়, উইকিলিকস এর
কেবলগুলি প্রকাশ করে দিয়েছে ভারতের আর্থিক ও বিদেশনীতির ওপর, এমনকী কেন্দ্রীয়
মন্ত্রীদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রভাব কতটা। ৩০জানুয়ারী ২০০৬ পাঠানো
আমেরিকান দুতাবাসের কূটনীতিক ডেভিড সি মালফোর্ড এর কেবলবার্তা অনুসারে দেখা যাচ্ছে
তিনি লক্ষ্য রাখছেন ২০০৬ এর জানুয়ারীতে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিং
সরকার নিযুক্ত করছে (কেবল এর মতে) আমেরিকাপন্থী মুরলী দেওরাকে, সরিয়ে দিচ্ছে মনী
শঙ্কর আইয়ারকে, যিনি (কেবল এ) বর্ণিত হচ্ছেন ইরাণ পাইপলাইন এর উচ্চকিত প্রস্তাবক
হিসেবে। মালফোর্ড এও বলেছেন “দেওরা সহ সাংসদদের একটা বড় অংশ আমাদের রণনৈতিক
সমঝোতার সঙ্গে প্রকাশ্যেই যুক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে সাতজন ভারত আমেরিকা যৌথ সংসদীয়
মঞ্চের সদস্য”। মন্ত্রীসভার অদল বদল প্রসঙ্গে মালফোর্ড এই বলে উপসংহার টানছেন,
“ভারত এবং ইরাণে এটা আমেরিকার লক্ষ্যের সঙ্গে ভীষণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ” এবং এটা
মনমোহন সিং সরকারের “ভারত আমেরিকা সম্পর্কের দ্রুত অগ্রগতিকে নিশ্চিত করতে দৃঢ়তার
প্রমাণ”।
প্রকাশিত কেবলবার্তা যেমন দেখিয়ে দিচ্ছে ভারতের
আর্থিক নীতির ওপর আমেরিকার নিবিড় নজরদারী ও নিয়ন্ত্রণ এর দিকটি, তেমনি প্রকাশ করছে
ভারতের মন্ত্রীরা বিভিন্ন কর্পোরেশনকে কেমন সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছেন সেই দিকটিও। একটি
কেবল বার্তায় আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিন্টন ভারতের তৎকালীন
অর্থমন্ত্রী সম্পর্কে জানতে চাইছেন, “মুখার্জী (প্রণব) কোন শিল্প বা বাণিজ্য
গোষ্ঠীর কাছে দায়বদ্ধ এবং কাদের তিনি আর্থিক নীতির মাধ্যমে সুবিধা পাইয়ে দেবেন?’’
হিলারী ক্লিন্টনের কেবল এটাও দেখিয়ে দেয় মন্ত্রীদের থেকেও আমেরিকাপন্থী আর্থিক
নীতি রূপায়ণে আমেরিকার কাছে যিনি বেশি বিশ্বস্ত, তিনি হলেন যোজনা কমিশনের ডেপুটি
চেয়ারপার্সন মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর মতোই যিনি কিনা
আই এম এফ দ্বারা নিযুক্ত। হিলারী প্রশ্ন করেছেন, “মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়ার পরিবর্তে
মুখার্জীকে কেন অর্থমন্ত্রীর পদে বসানো হল?’’
অন্যান্য কেবলগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে ইজরায়েল এবং
ইরাণ এর সঙ্গে তার সম্পর্কর প্রকৃত চেহারা নিয়ে ভারত সরকার তার জনগণের কাছে
মিথ্যাচার করেছে। একটি কেবল এরকম মনে করেছে ইরাণের সাথে দৃশ্যত ভারতের উষ্ণ
সম্পর্ক আসলে ‘লোকদেখানো, মূলত দেশের মুসলিম জনসমাজ এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের
অংশকে খুশি রাখার চেষ্টা’। আরেকটি কেবল তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে
নারায়ণনকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে দ্বিতীয়বার আই এ ই এ তে বিষয়টি আসার সময়ে ইরাণের
বিরুদ্ধে ভারতের ভোট দেবার ভাবনার কথা, কিন্তু ভয় আছে দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক
আধারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে।
আমেরিকার কেবলবার্তার নথি অনুসারে ভারতকে
আমেরিকার প্রতিনিধি সতর্ক করে জানাচ্ছেন আই এ ই এ তে ইরাণের বিরুদ্ধে ভারতের ভোট
দেবার ব্যর্থতা নিউক্লীয় চুক্তিকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। ঘটনাবলী দেখিয়ে দিয়েছে মনমোহন
সিং সরকার তাদের আমেরিকি প্রভুর নির্দেশানুযায়ীই ভোট দিয়ে তাদের সেবা করেছেন।
নিশ্চিতভাবেই ফাঁস হওয়া কেবল বার্তা জীবন্ত ও
বিস্ফোরক সব প্রমাণ হাজির করেছে। শুধুমাত্র ঘুষের বিষয়টিই নয়, বরং আমেরিকার
স্বার্থ রক্ষার তাগিদে ভারতের নিজের স্বার্থহানি ঘটানো এবং গণতন্ত্রকে বিপন্ন করার
মতো আরো গভীর অভিযোগই এতে যুক্ত।
প্রধান বিরোধী দল বিজেপি রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে
কর্পোরেট ও সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপকে তুলে ধরতে বা প্রতিরোধ করতে একেবারেই আগ্রহী
নয়। বস্তুতপক্ষে বিজেপি সহ সব শাসক দলই কর্পোরেট পক্ষপাতদুষ্ট। কর্পোরেটদের
সত্যিকারের কোন ক্ষতি করবে, এরকম কোন কিছু করতে তারা আদৌ প্রস্তুত নয়। রাডিয়া টেপ
এরকম অনেক ঘটনা তুলে ধরেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে বিজেপির উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বও
বাধ্যের মতো কর্পোরেট স্বার্থর সেবা করেছেন।
উইকিলিকস বিজেপির দ্বিচারিতাকে প্রমাণ করে
দিয়েছে। আমেরিকার ইচ্ছার কাছে মাথা নত করার ক্ষেত্রে কংগ্রেস বিজেপি এক গোয়ালেরই
গরু। বিজেপির একজন বরিষ্ঠ নেতৃত্বকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে তিনি আমেরিকার
প্রতিনিধিকে আশ্বস্ত করে জানাচ্ছেন আমেরিকার অধীনতার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিজেপির
করা ইউ পি এ সরকারের সমালোচনাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেবার দরকার নেই। এটা ইউ পি এ
সরকারের বিরুদ্ধে কিছু সমর্থন আদায় করে নেবার জন্য রাজনৈতিক ভাষণ মাত্র। আর একটি
কেবলের সূত্র অনুযায়ী লালকৃষ্ণ আদবানী নিউক্লিয় চুক্তি বিষয়ে বিজেপির সরকারী
বক্তব্যকে খাটো করে দেখাচ্ছেন আর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বিজেপি ক্ষমতায় এলে ইন্দো
আমেরিকি সম্পর্ক, এমনকি নিউক্লিয় চুক্তিকে পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আরেকটি
কেবলবার্তা দেখাচ্ছে নরেন্দ্র মোদিকে আমেরিকা ভিসা না দেওয়ায় অরুণ জেটল ক্রুদ্ধ
হয়ে বলছেন যে তিনি কিছুতেই এটা বুঝে উঠতে পারছেন না, যে পার্টি ইন্দো আমেরিকি
সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের কাজ শুরু করল তার নেতা সম্পর্কে আমেরিকা কিভাবে এরকম
সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একই কেবলে জেটলি খুচরো ব্যবসা ও আইনি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ
বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করছেন। আমেরিকান দূতাবাসের আধিকারিক মন্তব্য করেছেন যে
মোদিকে ভিসা দেওয়া সংক্রান্ত বিষয়টি ছাড়া ঐ সাক্ষাৎকারে জেটলি আগাগোড়া আমেরিকার
সঙ্গে ব্যক্তিগত ও অর্থনীতিগত সংযোগ স্থাপনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন। লোকের কাছে
জাতিয়তাবাদী সাজলেও আসলে বিজেপি যেমন আমেরিকার সাথে গাঁটছড়া বাঁধতেই দায়বদ্ধ,
তেমনি দুর্নীতি বিরোধী লোকদেখানো ভড়ং থাকলেও নব্যউদারনৈতিক অর্থনীতি ও কর্পোরেট
ভজনায় সে নিবেদিত প্রাণ।
ইউ পি এ র আমেরিকাপন্থী নীতির বিরুদ্ধে বিজেপির
তথাকথিত স্বদেশীর মুখোশ উইকিলিকস কেবল খুলে দিয়েছে। তাদের হিন্দুত্ব রাজনীতিও
সুযোগসন্ধানী বলে প্রমাণিত হয়েছে। জেটলি নিজেই সাক্ষাৎকারে হিন্দুত্ব রাজনীতিকে
সুবিধাবাদ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আমেরিকার প্রতিনিধিকে জেটলি বলেছেন, “উদাহরণ
হিসেবে ভারতের উত্তর পূর্ব কে নেওয়া যায়। সেখানে হিন্দুত্ব ভালো তাস, কারণ লোকের
মনে বাংলাদেশ থেকে মুসলিম অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত ভীতি আছে। ভারত পাকিস্থান সম্পর্কের
অধুনা উন্নতি হিন্দু জাতিয়তাবাদী রাজনীতিকে দিল্লিতে এখন কিছুটা গুরুত্বহীন করে
দিয়েছে, কিন্তু সীমান্তের ও পার থেকে পার্লামেন্ট হামলার মত কোন ঘটনা ঘটলেই সেটা
পালটে যেতে পারে।” এসব কথা দেখিয়ে দেয় পার্লামেন্ট আক্রমণের মত ঘটনাও বিজেপির কাছে
কাঙ্ক্ষিত হতে পারে, কারণ তা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জন্য উর্বর জমি তৈরি করে।
সাম্প্রতিক কালে এক জঘন্য দুর্নীতির ঘটনায় তাঁর
নিজের কর্পোরেট হাউসের লবিইস্ট নীরা রাডিয়া জড়িয়ে যাওয়ার পর রতন টাটা নেমেছেন আহত
শহীদের ভূমিকায় অভিনয় করতে। একটি মিডিয়া হাউসের ‘ওয়াক অ্যাণ্ড টক শো’ তে ইন্ডিয়ান
এক্সপ্রেস পত্রিকার সম্পাদক শেখর গুপ্তর সাথে কথা বলার সময় তিনি জানিয়েছেন,
বিশ্বরঙ্গমঞ্চে প্রবেশে জন্য ওবামা ভারতকে প্রশংসা করলেও তখন থেকে ভারত কর্ণি
ক্যাপিটালিজম (সরকারী আধিকারিকদের মদতপুষ্ট পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতি) ও ব্যানানা
রিপাবলিক (দুর্নীতিপরায়ণ গণতন্ত্র, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি সম্পর্কে প্রযুক্ত হত
কথাটি) এ পরিণত হবার বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। টাটা যখন কর্ণি ক্যাপিটালিজম বা
সরকারী আধিকারিকদের মদতপুষ্ট পুঁজিপতিদের দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতির কথা বলছিলেন, সেই কর্পোরেট লবিইস্ট এর কথা কি বলছিলেন, যিনি
মন্ত্রী, সরকার ও বিরোধী পক্ষ, বিচারক ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের তাঁর আঁচলের
তলায় রেখেছেন? যখন তিনি দুর্নীতিপরায়ণ গণতন্ত্রর কথা বলছিলেন, তিনি কি তখন সরকার ও
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তাপুষ্ট সেইসব অতি ধনী কর্পোরেট হাউসের কথা বলছিলেন,
যারা শাস্তির ভয়মুক্ত হয়ে আইন ভাঙে, গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে, দেশের অমূল্য সম্পদ
লুঠ করে? ঠিক যেরকম দুর্নীতি পরায়ণ গণতন্ত্র গড়ে উঠেছিল দক্ষিণ আমেরিকার
দেশগুলোতে? না, এসব টাটা বলছিলেন না। তিনি বলছিলেন একজন কর্পোরেট লবিইস্ট এর ফোন
ট্যাপ হওয়া এবং তার ‘ব্যক্তিগত’ কথা মিডিয়ায় ফাঁস হবার কথা। তিনি বোঝাতে চাইছিলেন
অন্য কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানীর স্বার্থে টাটার ভাবমূর্তি ম্লান করার কথা।
টাটা সতর্কবাণী দিয়েছেন, ‘মত প্রকাশের
স্বাধীনতার মতো তথাকথিত গণতান্ত্রিক অধিকার ইত্যাদির নামে যদি আমরা গণতন্ত্রবিলাস
এর অপব্যবহার করি’, তবে ভারত এমন একটা দেশে পরিণত হবে, যেখানে মানুষ ‘যথাযথ প্রমাণ
ছাড়াই জেলে যাবে বা তাদের দেহ গাড়ির ট্রাঙ্কে পাওয়া যাবে। এটা কৌতূহলজনক ব্যাপার
যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সাধারণভাবে গণতন্ত্রকেই টাটা
বিলাস বলে উল্লেখ করেছেন। সিঙ্গুরের কৃষক বা কলিঙ্গনগরের আদিবাসীরা সেই জগৎ
সম্পর্কে টাটাকে শেখাতে পারে, যেখানে জমি অধিগ্রহণের মত স্বার্থবাহী বিষয়ে
শক্তিশালী কর্পোরেটদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলে বিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘যথোপযুক্ত
প্রমাণ ছাড়াই জেলে যেতে হয়’, জমিতে মরে পড়ে থাকতে হয় অথবা পুলিশের গুলি খেয়ে মরে
যেতে হয়। টাটার দৃষ্টিতে কৃষক ও আদিবাসী জনগণের জীবন ও জীবিকার স্বার্থে কৃষি জমি রক্ষার লড়াই, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হল
গণতান্ত্রিক বিলাস। অন্যদিকে টাটার মত ধনকুবেররা উপভোগ করবেন ব্যক্তিগত গোপনিয়তার
গণতান্ত্রিক অধিকার এবং আদালতে গিয়ে ব্যক্তিগত গোপনিয়তার নামে প্রমাণ লোপের চেষ্টা
করবেন।
ভারতরাষ্ট্র ও তার শাসককুল কর্পোরেট স্বার্থের
বাইরে অন্য কিছুর দিকে প্রকৃত মনোযোগ দিতে তেমন আগ্রহী নয়। সারা দেশ জুড়েই তাই সরকারের
সাহায্যে কর্পোরেটদের দ্বারা চলছে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি ও জঙ্গল দখল। দখল চলছে
খনি, আবাসন ও অন্যান্য নানা ধরণের প্রজেক্ট ও শিল্প স্থাপনার জন্য। প্রতিটি
ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে জমি আইনকে ভাঙা হয়েছে, আর সরকারি আধিকারিকরা চোখ বুজে
থেকেছেন। কিন্তু এই কর্পোরেটকুল মদত পেয়েছে পুলিশি লাঠি গুলি আর দানবীয় আইনের।
যারাই একে প্রশ্ন করতে গেছেন, তাদের পড়তে হয়েছে ব্যাপক নিপীড়ণের মুখে।
আদিবাসী ও কৃষক সম্প্রদায় জমি হারানোর মুখোমুখি
হয়ে স্বাভাবিকভাবেই তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। কলিঙ্গনগর, জগৎসিঙ্ঘপুর, দাদরি,
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, সোমপেটা, শ্রীকাকুলাম – সর্বত্রই তারা মুখোমুখি হয়েছেন
পুলিশের নির্মম লাঠি গুলির। পুলিশি নিপীড়ণ ও সংগঠিত রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়ে অনেকে
হতাহত হয়েছেন। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে অধিকাংশ জনপ্রিয় আন্দোলনই মাওবাদী ঘরাণার
ছিল না, বরং ছিল জনতার সংগ্রাম। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী সবাইকেই
‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আদিবাসীরা তাদের আবাসভূমি জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ
হচ্ছেন। ছত্তিশগড়ে মাওবাদী দমনের নামে ‘সালওয়া জুডুম’ নামধারী বাহিনী মাওবাদী
দমনের নামে জোর করে হাজার হাজার আদিবাসীকে উচ্ছেদ করছে, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে
দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।
মাওবাদী দমনের নামে কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষ করে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অপারেশন গ্রীন্ট হান্ট নামক সেনা হামলা নামিয়ে এনেছে। কিন্তু
বোঝা যাচ্ছে মাওবাদের বাহানায় কর্পোরেট লুঠের স্বার্থে এটা আসলে গণপ্রতিরোধ আর
প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকেই নিশানা করেছে।
বিনায়ক সেনের মত যারা কর্পোরেট লুঠ আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নীতির বিরোধিতা করেন,
তাদের প্ররোচনাদাতা, সন্ত্রাসবাদীদের সমপর্যায়ভুক্ত বলে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিনায়ক সেন সেইসব হাজার হাজার কর্মী ও সাধারণ মানুষেরই একজন, যিনি কর্পোরেটদের
সম্পদ হরণের ঘটনাকে প্রশ্ন করায় কালা কানুনে বন্দী হয়ে জেলে গেছেন।
এটা মনে রাখা দরকার অপারেশন গ্রীন হান্ট নামিয়ে
এনেছেন যে চিদাম্বরম, তিনি নিজেই ২০০৪ এ অর্থমন্ত্রী হবার আগের দিন পর্যন্ত
বহুজাতিক মাইনিং কোম্পানী বেদান্ত এর অধিকর্তা ছিলেন। চিদাম্বরমের লক্ষ্য ও
ভাবনাচিন্তা প্রকাশিত হয়েছে মাহিন্দ্রার বিশেষ পরিষেবার সি ই ও রঘুরামনের কথায়। এই
রঘুরামন আবার চিদাম্বরমের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পেটোয়া প্রজেক্ট ন্যাটগ্রিড এর
মাথা, যারা গোয়েন্দা তথ্যাবলী সংযোজন করে। একটি রিপোর্ট এর রঘুরামন আশ্চর্যজনকভাবে
তার সুপারিশে বলেছেন, কর্পোরেটদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পা দেওয়ার সময় এসে
গেছে। এই ভাবনার সমর্থনে তিনি আমেরিকা, ইজরায়েল এবং অন্যান্য দেশের ব্যক্তিগত
নিরাপত্তা ব্যবস্থার উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন কর্পোরেটদের নিজেদের
নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তোলার অনুমতি দেওয়া হোক। বলেছেন ব্যবসায়ী সম্রাটরা যদি এখনই
তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য রক্ষায় এগিয়ে না আসে, তাহলে তাদের হয়ত দেখতে হবে তাদের
সাম্রাজ্যর সীমারেখা ভেঙে যাচ্ছে।
কর্পোরেটদের নিজেদের নিজস্ব সেনাবাহিনী রাখা আর
দূরের কোন কষ্টকল্পনা নয়। বস্তার, রায়গড়া, সিঙ্গুর বা জগৎসিঙ্ঘপুরে শাসক রাজনৈতিক
দলের সহায়তায় কর্পোরেটরা প্রতিবাদীদের ভয় দেখানো ও জোর করে কাজ হাসিল করার জন্য
নিজস্ব সশস্ত্র গোষ্ঠী গড়েই নিয়েছিল। অপারেশন গ্রীন হান্টও একটা এমন দৃষ্টান্ত
যেখানে ভারতের পুলিশ ও আধাসেনাকে কর্পোরেট সম্রাটদের সাম্রাজ্য রক্ষায় ব্যবহার করা
হচ্ছে।
শাসক পক্ষের দিক থেকেও
মাওবাদ/উগ্রপন্থার কারণ হিসেবে এই অসাম্য ও তা নিঃসৃত অবিচারের বিষয়কে অস্বীকার
করা সম্পূর্ণ সম্ভব হচ্ছে না, যদিও উৎসকে নয়, তার ‘প্রতিক্রিয়া’কেই দেশের
নিরাপত্তা ও গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে ঘোষণা সম্পন্ন হয়েছে। ভারতীয়
গণতন্ত্রের বহুবিধ সঙ্কটের সঙ্গে সমন্বিত আর্থিক বৈষম্যকে রাজনৈতিকভাবে তথাকথিত
‘মাওবাদ’/উগ্রপন্থা কতটা মোকাবিলা করতে সক্ষম, বা আদৌ সক্ষম কিনা তথা তা বর্তমান
আলোচনার বিষয় নয়। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের নানা স্বরূপের একটি দিককে বোঝার জন্য মাওবাদ
আজকে যে সমস্ত জায়গায় ভিত্তি খুঁজে পেয়েছে সেখানকার আর্থিক সামাজিক রাজনৈতিক
পরিস্থিতি আর সেইসঙ্গে মাওবাদকে দমনের নামে ভারতরাষ্ট্র যে পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে,
তার অনুপুঙ্ক্ষ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
ছত্তিশগড় ঝাড়খণ্ড ওড়িশা পশ্চিমবঙ্গ
অন্ধ্রপ্রদেশের আদিবাসী অধ্যুষিত বিস্তৃত ভূখণ্ডে অপারেশন গ্রীন হান্ট নামক এই মিলিটারি অপারেশনের মূল লক্ষ্য হিসেবে
সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে
“দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রধান বিপদ” মাওবাদের কথা। মিডিয়াতে মাওবাদীদের নানা বিস্ফোরণ ও সেনা পুলিশের ওপর
হামলার ঘটনাও সামনে আসছে। কখনো কখনো তারা ‘চর’ সন্দেহে হত্যা করছে স্থানীয় গ্রামবাসীদের। এসব ঘটনা রাষ্ট্র তার সুবিধে
মতো প্রচারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেই চলেছে। আর মিডিয়া জুড়ে হিংসা প্রতিহিংসার
কাহিনীর আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে তীব্র বঞ্চনা আর শোষণের কাহিনীগুলো। তার রাজনীতি ও
অর্থনীতিগুলো। আর
এই হারিয়ে যাওয়া কথাগুলো ভারতীয় গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধ পরিসরকেই বারবার মনে করিয়ে
দিচ্ছে।
আমরা যদি ভারতের মানচিত্রের দিকে তাকাই তাহলে
দেখব ভারতের আদিবাসী অঞ্চল আর খনি
অঞ্চল এর মানচিত্রটা অনেকটা এক। ছত্তিশগড় ঝাড়খণ্ড ওড়িশার অনেকটা জায়গা ভারতের খনি
ও আকরিকের এক বড়ো সম্ভার। এগুলোই আবার ভারতের দরিদ্রতম মানুষজন আদিবাসীদের বসবাসের
এলাকা। এই বৈপরীত্য স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ মর্মান্তিক এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
স্বাভাবিক। শুধু আজ নয়, ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘলালিত কাঠামোগত বঞ্চনার বিরুদ্ধে আদিবাসীদের
বিক্ষোভের ইতিহাস বেশ পু্রোনোই। কিন্তু ইংরেজ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী শোষণমূলক নীতি
থেকে আজকের স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারত সরকারের নীতি ও শাসনপদ্ধতি ততটা আলাদা হতে
পারে নি, যাতে আদিবাসীদের মনে হয় তারাও সুযোগ সুবিধা
সম্পদে এদেশের মূল স্রোতের অঙ্গ। বঞ্চনার বোধ তাদের মধ্যে সঙ্গতভাবেই থেকে গেছিল।
এর সাথেই সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নিওলিবারাল শাসননীতির দুনিয়ায় শুরু হয়েছে শোষণ
অত্যাচারের এক নতুন অধ্যায়। শুরু করা যাক মাইনিং এর বিষয়টা দিয়েই। আমরা জানি
ছত্তিশগড় ঝাড়খণ্ড অন্ধ্রপ্রদেশ হল দেশের মধ্যে কয়লা লোহা বক্সাইটের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার।
কেবলমাত্র সরকারের হাতে থাকা মাইনিং এর অধিকার কয়েকবছর আগে আইন করে দিয়ে দেওয়া
হয়েছে দেশি বিদেশি পুঁজিপতিদের। একচেটিয়া পুঁজি মুনাফার স্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়েছে
খনি অঞ্চলগুলিতে। পাহাড় থেকে খনি – আকরিক দখলের মরীয়া
চেষ্টার সামনে আদিবাসীদের বসতি জীবিকা অধিকার ইত্যাদি নেহাৎ অপ্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে
উঠেছে । একের পর এক মৌ চুক্তি হচ্ছে টাটা পস্কো এসার মিত্তল জিন্দাল বেদান্ত এর
মতো কম্পানীগুলোর সঙ্গে। এরা প্রচুর মুনাফাগন্ধী যে খনিকাজ চালানোর জন্য আওসছে
উচ্ছেদ তাতে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আর তাতে পুনর্বাসনের বিষয়টি ভীষণভাবেই
অবহেলিত। সরকার নিজের জানানো তথ্যেই বলেছে পুনর্বাসন দেওয়া যায়নি এমন আদিবাসীর
সংখ্যা ১কোটি ৪৪ লক্ষ, যদিও বাস্তবে সংখ্যাটা অনেক অনেক
বেশি, আর সেটা প্রতিদিন বাড়ছে। এ অবস্থায় আদিবাসী
প্রতিরোধ আর বিক্ষোভ অত্যন্ত প্রত্যাশিত ঘটনা। মৌ চুক্তির পর কোম্পানীগুলি,
যারা সরকারকে পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করে, দাবী
জানাচ্ছে ‘নিরাপত্তার’, যাতে
তারা নির্বিঘ্নে জমি দখল করতে পারে আর সরকার কখোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী, যেমন কোবরা গ্রে হাউণ্ড, কখোনো মদতপুষ্ট
প্রাইভেট বাহিনী, যেমন সালওয়া জুদুম দিয়ে তাদের দাবী পূরণ
করছে। আদিবাসীদের ওপর তীব্র আক্রমণ আর গণতান্ত্রিক অধিকারগুলির চূড়ান্ত অস্বীকারকে
বৈধতা দিতেই আসছে মাওবাদী দমনের প্রসঙ্গটি।
শুধু মাওবাদ/উগ্রবাদ দমনের নামে শোষণ বঞ্চনা ও
কর্পোরেট লুন্ঠনের ইতিবৃত্তকে চাপা দিতেই যে শাসক শ্রেণি মরীয়া সেনা আগ্রাসন
চালাচ্ছে তাই নয়, অতীতে আমরা দেখেছি দেশের মধ্যে বিভিন্ন জনজাতির জাতিসত্তার
আকাঙ্ক্ষাকে দমন করার আয়োজনে সে ভিন্ন কোনও রাস্তায় হাঁটতে আগ্রহী নয়। একদিকে
সেনাবাহিনী, অন্যদিকে অগণতান্ত্রিক বিভিন্ন কালাকানুন সমূহ কাশ্মীর ও উত্তর পূর্ব
ভারতের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে বিদ্যামান। পোকা ও পোটার মত দানবীয় আইনের মারাত্মক
অপপ্রয়োগের পর তাকে বাতিল করা হয়েছে, কিন্তু সেই তীব্র অগণতান্ত্রিক আইনের ধারাতেই
তৈরি করা হয়েছে আনলফুল অ্যাক্টিভিটি প্রিভেনশন অ্যাক্ট বা বজায় রাখা হয়েছ আর্মড
ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট। ভিন্ন স্বরের সঙ্গে সংলাপকে যদি গণতন্ত্রের
অন্যতম শর্ত হিসেবে গণ্য করা হবে, তবে মানতেই হবে ভারতরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী
স্বরকে অন্যস্বরের সঙ্গে সংলাপে নয়, দমনেই বেশি আগ্রহী ও আগ্রাসী চেহারায় দেখা
যায়।
দ্রুত অতি মুনাফা অর্জনের ন্যায় নীতিহীন
অর্থনীতি তার নিজের স্বার্থে গড়ে নিতে চাইছে সমকালীন ভারতবর্ষ ও তার গণতান্ত্রিক
পরিসরকে। সেখান থেকেই কর্পোরেট স্বার্থবাহী আগ্রাসন ও দুর্নীতির বড় বড় ঘটনাগুলি
সামনে আসছে। দানবীয় সব কালাকানুন, কর্পোরেট মহলকে করছাড়ের বিপুল আয়োজন, কালো
টাকাকে বিদেশ থেকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সদিচ্ছার প্রবল অভাব, কর্পোরেট স্বার্থে
আইন, মন্ত্রক, দেশের নীতিকে বদলে ফেলার উদ্যোগ, যা বস্তুতপক্ষে রাডিয়া টেপ এবং
উইকিলিকস এর ফাঁস হওয়া তথ্যাবলী দিনের আলোর মত স্পষ্ট করে দিয়েছে - দেখায় যে ভারত
ইতোমধ্যেই অনৈতিক গণতন্ত্র বা ব্যানানা রিপাবলিক হবার রাস্তায় অনেকদূর এগিয়ে গেছে।
এখানে কর্পোরেট ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি কর্পোরেট স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে
গণতন্ত্র ও জনাধিকারকে ধ্বংস করছে। নামিয়ে আনছে ব্যাপক দমন পীড়ণ। যদি অবিলম্বে নব্যউদারনৈতিক
নীতিসমূহকে পালটানো না যায় তা হলে অচিরেই ভারত একটি ক্ল্যাসিকাল ব্যানানা রিপাবলিক
বা অনৈতিক গণতন্ত্রর উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। নয়া উদারবাদের কাছে আত্মসমর্পণের একটি
পর্বের পর দক্ষিণ আমেরিকার পূর্বতন ব্যানানা রিপাবলিকগুলি এক নতুন জাগরণের মধ্য
দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে জনপ্রিয় সরকার ও আন্দোলনগুলি সাম্রাজ্যবাদের শক্তিশালী ভূমিতে
দাঁড়িয়েই তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়ার মত
অনেক দেশে রাজনীতি আর অর্থনীতির পট পরিবর্তন সেখানকার মানুষের গণতান্ত্রিক
অধিকারের নতুন দিক উন্মোচন করছে। ভারতরাষ্ট্র ও তার জনগণের সংগ্রাম আমাদের সম্পদের
সাম্রাজ্যবাদী ও কর্পোরেট লুন্ঠন, আমাদের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের বিপদের প্রশ্নে
নয়া উদারনীতির বিরুদ্ধে সংকল্পবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে কিনা, সেটাই ভারতীয়
গণতন্ত্রের সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
No comments:
Post a Comment