Tuesday, October 2, 2018

গ্রামীণ অকৃষি কর্মসংস্থান : সরকারী প্রকল্পগুলির পর্যালোচনা


ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সঙ্কটের মুখে গ্রামীণ অকৃষি কর্মকাণ্ড ক্রমশ বাড়ছে। এই কর্মকাণ্ডর একটা বেসরকারী উদ্যোগের দিক আছে, যেমন নির্মাণ শিল্প, যেখানে গ্রামীণ শ্রমিকরা পরিযায়ী হয়ে শহর, শহরতলী বা দূরের মহানগরে কাজ করতে চলে যান। বা গ্রামের মধ্যেই বা কাছাকাছি গড়ে ওঠা বিড়ি শিল্প, জড়ি শিল্প, ভেড়ী, পোলট্রি, ডেয়ারী, ইঁটভাটা, বিভিন্ন রকম খাদান বা ছোট মাঝারী শিল্প কারখানা – যেমন আলমারি, রঙ, গ্রীল ইত্যাদিতে কর্মসংস্থানের পথ বেছে নেন। গ্রামীণ অকৃষি কাজের এই প্রধান ক্ষেত্রটির পর্যালোচনা পরবর্তী ক্ষেত্রে করার আগে আমরা এখন দেখে নিতে চাই সরকারী উদ্যোগ পোষিত গ্রামীণ অকৃষি ক্ষেত্রের চেহারাটা। এর মধ্যে আছে আশা প্রকল্প, মিড ডে মিল প্রকল্প, অঙ্গনওয়ারী প্রকল্প, সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্প, এন আর ই জি এ প্রকল্প প্রভৃতি।
ভারত সরকারের পরিবার ও স্বাস্থ্যকল্যাণ দপ্তরের উদ্যোগে ২০০৫ সাল থেকে ভারতের গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন প্রকল্পের অংশ হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়ে মহিলাদের নিয়োগ করা শুরু হয়। এই মহিলাদের কাজ হল এলাকায় স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা। জননী যেন হাসপাতালে প্রসব করেন সেটা দেখা, নবজাতক ও নবজাতিকার টীকাকরণ যেন সঠিক ও নিয়মিত হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখা, পরিবার পরিকল্পনায় উৎসাহ দেওয়া, সাধারণ অসুখ ও আঘাতে প্রাথমিক চিকিৎসা করা, গ্রামীণ পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর রাখা, জন্ম মৃত্যুর হিসেব রাখার মতো নানাবিধ কাজ আশা কর্মীদের করতে হয়। প্রতি গর্ভবতী মাকে প্রসবের জন্য হাসপাতালে নিয়ে গেলে পাওয়া যায় ২০০ টাকা। হাসপাতালে প্রসূতির সঙ্গে থাকলে মেলে ১২০ টাকা। বাড়িতে জন্মানো সদ্যোজাতকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেখতে গেলে পাওয়া যায় ১০০ টাকা। তারপর কয়েক দিন অন্তর ছ’বার দেখতে যাওয়ার জন্য প্রতি দিন ৪০ টাকা করে দেওয়া হয়। জন্মের পর থেকে এক বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত টিকাকরণ করলে পাওয়া যায় দেড়শো টাকা। জন্ম-মৃত্যুর প্রতিটি খবর-পিছু ২০ টাকা করে বরাদ্দ। মহামারির খবরের জন্য দেওয়া হয় ২০ টাকা করে। যক্ষ্মারোগীর খবর আনলে এবং ওই রোগীকে তত্ত্বাবধানের জন্য রোগী-পিছু পাওয়া যায় আড়াই হাজার টাকা। আন্দোলনের ফলে এর কোন কোনটি সাম্প্রতিক কালে অল্প বেড়েছে। কিন্তু ভাতাগুলি পাওয়া নিয়ে তাদের মাঝে মধ্যেই নানা সমস্যায় পড়তে হয়। বিশেষ সমস্যা হয় প্রসবকালীন ভাতার ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামীণ গর্ভবতী মায়েদের আশা কর্মীরা ন মাস দেখভাল করলেও প্রসবের সময় পারিবারিক সিদ্ধান্তে প্রসব হয় বেসরকারী কেন্দ্রে। সেক্ষেত্রে কোনও ভাতা মেলে না। রাতে প্রসবের ক্ষেত্রে পরিবারের লোকেরা সরকারি হাসপাতালে তাদের নিয়ে গেলে, আর সে সময় আশা কর্মীদের না ডাকলেও তাদের ভাতা পেতে অসুবিধে হয়, কারণ বিধি অনুযায়ী আশা কর্মীদেরই প্রসবের সময়ে গর্ভবতী মাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব। এসমস্ত জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে আশা কর্মীরা দীর্ঘদিন থেকেই নিয়মিত মাসিক ভাতার দাবি জানিয়ে আসছেন, কিন্তু তাদের সে দাবি এখনো পূরণ হয় নি। ২৭ ফেব্রুয়ারী নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসব ভাতার অতিরিক্ত মাসিক ১৩০০ টাকা বেতন আশা কর্মীদের জন্য ঘোষণা করেছেন। প্রত্যাশার তুলনায় অবশ্য এটা অনেকটা কম আর ঘোষণা হয়ে গেলেও এটা এখনো আশা কর্মীরা কেউ হাতে পান নি, কবে থেকে পাবেন তাও জানেন না। এছাড়াও আশা কর্মীদের প্রায়শই হাসপাতালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নানারকম দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হয়। দীর্ঘ সময় হাসপাতালে অপেক্ষা করতে হলেও ন্যূনতম কোনও ঘর তাদের জোটে না। এই সমস্যার প্রশ্নেও দ্রুত সুরাহার দাবি তাদের দিক থেকে রয়েছে।
প্রাক প্রাথমিক শিশুদের শিক্ষার জন্য নিযুক্ত রয়েছেন অঙ্গনওয়ারি কর্মীরা। সম্প্রতি অঙ্গনওয়ারি শিক্ষিকা আর সহায়িকাদের বেতনও কিছু বেড়েছে, যদিও তা দাবির তুলনায় বেশ কম। তবে স্থায়ীকরণের মূল দাবিটি নিয়ে সরকারের তরফে কোনও হেলদোল নেই। কিন্তু মূলত ছোট শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা যে অঙ্গনওয়ারি মাধ্যমে, সেখানে বেশিরভাগ জায়গাতেই নেই উপযুক্ত কোনও আস্তানা। বাধ্য হয়ে পড়াশোনা চলে গাছের নিচে বা এমনকি গোয়াল ঘরেও। এই সমস্যা থেকে মুক্তির দাবিটি দীর্ঘদিন চালু হওয়া এই প্রকল্পটিতে এখনো প্রবল উপেক্ষিত।
শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে মিড ডে মিল প্রকল্প চালু হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন এবং ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টির প্রশ্নে এই ধরণের একটি প্রকল্পের উপযোগিতা শিক্ষামহলে সকলেই স্বীকার করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় এই প্রকল্পটি চলছে রন্ধনকর্মীদের চূড়ান্ত শোষণের বিনিময়েই। রবিবার ব্যতীত সপ্তাহে ছদিন তারা সকাল বেলা হাজির হন বিদ্যালয়ে, অনেক জায়গাতেই বাজার করার সময়সাপেক্ষ কাজ সেরে। তারপর সারাদিন চলে রান্না, পরিবেশন, বাসনপত্র থেকে খাবার জায়গা সাফসুতরো করার কাজ। বিকেলের দিকেই অবসর মেলে বাড়ি ফেরার। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর মাসিক বেতন মাত্র হাজার টাকা, যা যে কোন মানদণ্ডেই চূড়ান্ত শোষণের নিদর্শন। এর পরে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা শাসক দল ক্ষমতার দাপটকে কাজে লাগিয়ে আবার অনেক জায়গায় বেশি রন্ধনকর্মী ঢুকিয়ে দেন প্রকল্পে, আসা টাকা ভাগ হয়ে যায়, মাত্র হাজার টাকাও রন্ধনকর্মীরা পান না। ইদানীং নয়া বিধি অনুসারে তারা বারো মাসের মাইনেও পাচ্ছেন না, মিলছে দশ মাসের। যদিও পুজোর ছুটি বা গরমের ছুটি একমাসের বেশ কমই থাকে, কিন্তু একমাসের বেতনটুকু কেটে রাখা হয়। ভাতা বৃদ্ধির অতি জরুরী দাবির পাশাপাশি বোনাসের সঙ্গত দাবিও রন্ধনকর্মীরা রেখেছেন সরকারের কাছে।
গ্রামীণ শ্রমজীবী জনগণের একটা বড় অংশ সরকারী প্রকল্পে কর্মরত মহিলারা। শ্রমিক আন্দোলন ও মহিলা আন্দোলনের সৃজনশীল সমাহারের মধ্য দিয়ে এই কর্মীদের রাজনৈতিক ভাবে সংগঠিত করা আজকে একটা গুরূত্বপূর্ণ গ্রামীণ কাজ। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের দাবি দাওয়ার পাশাপাশি তাদের অসংগঠিত শ্রমিকের সাধারণ আন্দোলনের অংশ করে তোলাও অগ্রণী রাজনৈতিক কর্মীর দায়িত্ব। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গ্রামীণ রাজনীতিতে তাদের কি মাত্রায় সক্রিয় করে তোলা যাচ্ছে, তা গ্রামীণ রাজনীতির অন্যতম নির্ণায়ক সূত্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনায় উজ্জ্বল।
শহরের পাশাপাশি গ্রামের প্রাথমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে কর্মরত পার্শ্বশিক্ষকদের বড় রকমের বাহিনীটি আজ বিক্ষুব্ধ। অনেক বছর হলো তাদের সামান্য দক্ষিণা/ বেতন স্থবির। নেই ডি এ, বা অসুস্থতা জনিত চিকিৎসার কোনও ভাতা। নিয়মিত শিক্ষকদের মতো সব কাজ সামলানোর পর তাদের বরাতে জোটে বিডিও অপিস থেকে আসা জনগণনা সহ হাজারো কাজ, যার চাপে তাদের একদিকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরেকদিকে বিডিও প্রভৃতি প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষর জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়। শিক্ষক হয়েও তাদের ঠিকা কর্মীর চরিত্রটা বেশ স্পষ্ট। শিক্ষক হিসেবে তাদের মর্যাদার আন্দোলন চলছে ঠিকা কর্মীর বাস্তব অবস্থানে দাঁড়িয়েই। তাদের সঙ্গবদ্ধ করে নিজস্ব দাবিভিত্তিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাধারণভাবে সরকারী প্রকল্পে ঠিকাকর্মীদের সংযুক্ত আন্দোলনে তাদের সামিল করানো ও স্বাভাবিক শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে তাদের আগ্রহী অংশটিকে অগ্রণী সংগঠক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা জরুরী। বিহার ঝাড়খণ্ড সহ যেসমস্ত জায়গায় এই কাজে বেশ কিছু সাফল্য পাওয়া গিয়েছে, তার থেকে পশ্চিমবঙ্গেও এ বিষয়ে আমরা বেশ কিছু শিক্ষা ও প্রেরণা নিতে পারি।
ভারতের মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পটি বৃহৎ সামাজিক প্রকল্প হিসেবে ব্যাপকভাবে চর্চিত। কিন্তু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে তার বাস্তব রূপায়ণে ফারাক আসমান জমিন। নামে একশো দিনের প্রকল্প হলেও বাস্তবে কাজ মেলে কুড়ি পঁচিশ দিন। কোথাও বা আরেকটু বেশি। ফলে বছরে ষাট দিন মতো ক্ষেতমজুরের কাজ পাওয়া গ্রামীণ মেহনতি মানুষের বার্ষিক দিন গুজরানের ক্ষেত্রে এই প্রকল্প বাড়তি সুবিধা সামান্যই দেয়। দিন পঁচিশ এর বেশি কাজ পাওয়া সম্ভব হয় না, পাশাপাশি এ নিয়ে দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপক। কাজ না দিতে পারলে ভাতা দেবার যে নিয়ম আছে, সেটা প্রায় মানাই হয় না। যতজন কাজ করে, তার চেয়ে বেশি লোকের নাম মাস্টার রোলে দেখিয়ে গ্রামীণ মুরুব্বি সরকারী কর্তাব্যক্তিদের গাঁটছাড়া অতিরিক্ত টাকার ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেয়। খাতায় কলমে কর্মসংস্থান আর বাস্তবের হিসেবে তৈরি হয় ব্যাপক গরমিল। কাজ করে টাকা পাওয়াটাও নানা সময়ে বেশ দুর্ভোগের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক মুরুব্বিয়ানা ভালোরকম সক্রিয় থাকে। এসবের বিরুদ্ধে এলাকাভিত্তিক তথ্যের ওপর আন্দোলন গড়ে তোলার সুযোগ ও প্রবণতা স্বাভাবিক ভাবেই গ্রামীণ রাজনীতিতে যথেষ্ট।
সরকারী বিভিন্ন প্রকল্পর দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ রাজনীতিতে একটি বিশেষ রাজনৈতিক মাত্রাও সংযুক্ত হয়েছে। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সম্পন্ন হলেও উল্লিখিত প্রকল্পগুলি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প হওয়ায় এ নিয়ে দেশীয় রাজনৈতিক কাঠামোর ওপরের চিত্রের একটা আদল গ্রামীণ জনগণের কাছে স্পষ্ট করার সুযোগ ও প্রয়োজনিয়তা আছে। সরকারী আধিকারিক ও কর্তাব্যক্তিরা বহুক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রকল্পের অব্যবস্থা ও ব্যাপক দুর্নীতির মদতদাতা ও প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। গ্রামীণ মুরুব্বি, পঞ্চায়েতের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে মিলিতভাবে সমস্ত প্রকল্পগুলি তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। শুধু পঞ্চায়েত কাঠামোর মধ্যে থাকা ব্যক্তিবিশেষের দুর্নীতি বা নির্দিষ্ট পঞ্চায়েত বোর্ডের দুর্নীতির বাইরে গোটা সামাজিক রাজনৈতিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার অকর্মণ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ ছবিটি স্পষ্ট করে তুলে গোটা ব্যবস্থার পচন আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত পরিবর্তনের প্রয়োজনিয়তা গ্রামীণ জনগণের সামনে তুলে আনা দরকার। এর চলমান প্রয়াস গ্রামীণ রাজনীতিকে অর্থনীতিবাদের ওপরে স্থাপন করতেও নিশ্চিতভাবে সাহায্য করবে।

No comments: