Tuesday, October 2, 2018

গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সাম্প্রতিক প্রবণতা : রাজনৈতিক তাৎপর্য


গত দু দশকে পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা ভারতের কাজের জগৎ এর ছবিটা বদলাচ্ছে খুব দ্রুত আর বেশ প্রবল ভাবে। এই বদলের অর্থনৈতিক তাৎপর্য যেমন আছে, তেমনি আছে সামাজিক রাজনৈতিক তাৎপর্যও। শহর তো বদলাচ্ছেই, গ্রামও কিন্তু বদলে যাচ্ছে বেশ দ্রুত গতিতে। যে সমীক্ষাগুলো হয়েছে তার পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাচ্ছে স্থবির, অনড় গ্রামসমাজের কথা ভাবা এখন অনেকটাই অবাস্তব, কল্পনা প্রসূত। সক্রিয় সমাজ রাজনৈতিক কর্মীর কাছে নিশ্চয়ই ব্যাপারটি অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট। গ্রাম ও তার সামাজিক গঠন, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ তথা রাজনীতিকে শুধুই কৃষির অবস্থান ও প্রেক্ষিত থেকে বিচার করার সীমাবদ্ধতাও আজকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য দেখিয়ে দিচ্ছে গ্রামীন রাজনীতিকে আত্মস্থ করতে হলে কৃষির পাশাপাশি নজর ফেরাতে হবে অকৃষি ক্ষেত্রেও। বিকাশমান পরিস্থিতির চরিত্রকে আয়ত্ত করতে হবে।
কী বলছে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পরিসংখ্যান ? এই সমীক্ষা ভারতের কর্মসংস্থানের একটা তুলনামূলক ছবিকে হাজির করছে। ২০০৪-০৫ সালে ভারতের মোট কর্মী সংখ্যার শতকরা ৫৬.৪ শতাংশ ছিলেন স্বনিযুক্ত, যার সিংহভাগ নিঃসন্দেহে বিভিন্ন স্তরের কৃষক। বেতনপ্রাপ্ত নিয়মিত শ্রমিক আর কর্মচারী ছিলেন মোট কর্মীর ১৫.২ শতাংশ। আর ঠিকা শ্রমিক ছিলেন ২৮.৩ শতাংশ। এই হিসেবটা বদলে যাচ্ছে ২০০৯-১০ এ এসে। ২০০৯-১০ সালে ভারতের মোট কর্মী সংখ্যার শতকরা ৫০.৭ শতাংশ ছিলেন স্বনিযুক্ত। বেতনপ্রাপ্ত নিয়মিত শ্রমিক আর কর্মচারী ছিলেন মোট কর্মীর ১৬.৪ শতাংশ। আর ঠিকা শ্রমিক ছিলেন ৩৩ শতাংশ।
এই সমীক্ষা এটাও স্পষ্ট করছে যে দেশের মোট কর্মী সংখ্যার কিন্তু বিশেষ পরিবর্তন হয় নি। ২০০৪-০৫ এ যেটা ছিল ৪৫ কোটি ৭৮ লক্ষ, ২০০৯-১০ এ এসে সেটা হয়েছে ৪৫ কোটি ৯১ লক্ষ। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার নগণ্য, অথচ এ সময়ে একদিকে জনসংখ্যা ও অন্যদিকে দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল যথেষ্ট। নমুনা সমীক্ষা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে এ সময়ে প্রকৃত বেকারত্মের হার বেড়েছে আর যে জিডিপির বৃদ্ধি হয়েছে, তার সঙ্গে কর্মসংস্থান এর সম্পর্ক নগণ্য। আমরা চেনা ভাষায় বলতে পারি ‘জবলেস গ্রোথ’।
কর্মসংস্থান বাড়েনি, কিন্তু কাজের ধরণের পরিবর্তন হয়েছে। দেশের স্বনিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা ২০০৪-০৫ এ ২৫ কোটি ৮৪ লক্ষ থেকে ২০০৯-১০ এ কমে হচ্ছে ২৩ কোটি ২৭ লক্ষ। হ্রাসের হার ৫.৭ শতাংশ। এই তথ্যের অর্থটা খুব পরিস্কার। দেশের স্বনিযুক্ত কর্মীদের সংখ্যা অর্থাৎ মূলত কৃষকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কৃষকদের একটা অংশ যদি চাষ ছেড়ে দেন তবে তারা কী ধরণের কাজে যুক্ত হচ্ছেন ? বেতনভূক কর্মীর মোট সংখ্যা বা শতাংশ মাত্রা সেভাবে বাড়ে নি। যেটা বেড়েছে সেটা হল ঠিকা শ্রমিকের মোট সংখ্যা ও শতাংশ মাত্রা। ২০০৪-০৫ যেটা ছিল ১২ কোটি ৯৭ লক্ষ, ২০০৯-১০ এ সেটা হল ১৫ কোটি ১৩ লক্ষ।, বৃদ্ধির হার ৪.৭ শতাংশ।
কেন কৃষকদের একটা অংশ চাষ ছেড়ে দিচ্ছে তার আলোচনা আমাদের বর্তমান পর্যালোচনার মূল বিষয় নয়। সেটা নিয়ে আলাদা গভীর বিশ্লেষণ দরকার। সাধারণভাবে বলা যায় কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, যার মধ্যে আছে বিদ্যুৎ ডিজেল সার সেচ প্রভৃতি, চাষের খরচ প্রচুর বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় ফসলের দাম বাড়েনি, খোলা বাজারে কৃষি পণ্য বেশি দামে বিক্রি হলেও তার সুফল চাষী পান না, সেটা মধ্যসত্ত্বভোগী ফোড়েদের হাতেই চলে যায়। সরকারের তরফ থেকে যেটুকু করার ছিল সে বিষয়ে তারা একেবারেই উদ্যোগী না হওয়ায় সঙ্কট আরো বেড়েছে। কেন্দ্রীর সরকার ডিজেলের দাম নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী নয়, ফলে সেচের খরচ বাড়ছে ভীষণভাবেই। সারের দামবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। রাজ্য সরকার প্রচারের ঢক্কানিনাদ চালালেও সহায়ক মূল্যে ফসল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ভীষণ রকম উদাসীন। এ নিয়ে ভালো রকম নৈরাজ্যও আমরা গত দু বছর প্রত্যক্ষ করেছি, যা পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশ বেড়ে চলা কৃষক আত্মহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আত্মাহূতির পেছনে আর একটি বড় কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাঙ্ক ঋণের বেশ কম সুযোগ, আর তার জায়গায় কৃষকদের বাধ্য হয়ে নেওয়া চড়া সুদের মহাজনী ঋণের ফাঁস। পচনশীল বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত্রে উপযুক্ত হিমঘর ইত্যাদির অভাবেও চাষীরা উপযুক্ত দাম পান না, বছরের পর বছর ধরে সরকার এ বিষয়ে উদাসীন। সরকারী উদাসীনতা আর ব্যর্থতা চাষীদের সর্বণাশ করলেও গ্রামীণ কায়েমী স্বার্থ, সার বীজের কালোবাজারি, সেচের বা হিমঘরের নিয়ন্ত্রক আর মহাজনী পুঁজিকে সুযোগ দেয় আরো ফুলে ফেঁপে ওঠার। নমুনা সমীক্ষা থেকে উঠে আসা বাস্তবতা গ্রামীন আন্দোলনে বিশেষত ছোট ও মাঝারী চাষীর সঙ্কটকে অক্ষ করে তোলার প্রয়োজনিয়তার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। তাদের ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনের গড়ে তোলার সাফল্যের ওপরেই আজকের গ্রামীণ রাজনীতিতে সাফল্য অনেকটা নির্ভর করছে।
গ্রামীণ সর্বহারাদের মধ্যে ক্ষেতমজুরদের সংখ্যাই এখনো সর্বাধিক। আর কৃষি সঙ্কটের আড়ালে তাদের মজুরী বৃদ্ধির প্রশ্নটা ভীষণভাবেই উপেক্ষিত। সরকারের পক্ষ থেকে দাবী করা হয় এন আর ই জি এ প্রকল্প গ্রামীন জনগণের মজুরী বৃদ্ধির সহায়ক হবে। বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই একশো দিনের কাজের প্রকল্প নামে থাকলেও কাজ মেলে বছরে মাত্র দশ পনেরো দিন। কাজ দিতে না পারলে টাকা দেওয়ার যে নিয়ম রয়েছে মানা হয় না তাও।
এন আর ই জি এ ছাড়াও গ্রামীণ কর্মসংস্থানকে সহায়তা করার জন্য বেশ কিছু সরকারী প্রকল্প রয়েছে, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও নির্দিষ্ট বেতন নেই, রয়েছে সামান্য সম্মান দক্ষিণা মাত্র। মিড ডে মিল কর্মী, অঙ্গনওয়ারী কর্মী, আশা কর্মীদের সম্মান দক্ষিণা হিসেবে যা দেওয়া হয় তা অপ্রতুল এবং অমানবিক। এর সঙ্গেই উল্লেখ করা যায় শহরের পাশাপাশি গ্রামেও পরিব্যাপ্ত প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত পার্শশ্বিক্ষক বা শিক্ষাবিভাগে কর্মরত শিক্ষাবন্ধুদের কথা। সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের সর্বত্র সরকারি প্রকল্পে নামমাত্র সম্মান দক্ষিণায় কর্মরতদের সম্মানজনক মজুরীর দাবী গ্রামীণ আন্দোলন ও রাজনীতির অন্যতম গুরূত্বপূর্ণ বিষয়।
বাড়তে থাকা বেকারত্ম ও কম মজুরী জনিত দারিদ্র্য নূন্যতম জীবন ধারণের জন্য সরকারী সুবিধা পেতে বাধ্য মানুষদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়িয়ে তুলছে। কিন্তু দারিদ্র সীমার নিচে থাকা মানুষদের একটা বড় অংশ বি পি এল কার্ড পান না। এ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতিও চলতে থাকে। রেশনিং বা গণবন্টন ব্যবস্থার দুর্নীতি নিয়ে অসন্তোষ কিছুদিন আগে জেলায় জেলায় ক্ষোভের ঝড় হয়ে আছড়ে পড়েছিল ও তৎকালীন শাসকদের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিল। বি পি এল ভুক্ত মানুষের উপযুক্ত কার্ড ও গণবন্টন ব্যবস্থার সুবিধার দাবিতে আন্দোলন দারিদ্র পীড়িত বর্তমান গ্রাম বাংলারও অন্যতম বাস্তবতা।
সরকারী প্রকল্পর বাইরে অকৃষিভুক্ত গ্রামীণ অর্থনীতি (নন ফার্ম রুরাল ইকনমি)র যে বিকাশ আজকে পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশেই হচ্ছে তার খতিয়ান নেওয়া বর্তমান গ্রামীণ রাজনীতিকে আয়ত্ত করার অন্যতম চাবিকাঠি। হ্যাজেল আর হ্যাগাবেল এর করা ভারতের ৮৫টি গ্রামের ওপর কিছুদিন আগে প্রস্তুত একটি সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে গ্রামীণ কৃষিক্ষেত্রে ১ টাকা আয় বৃদ্দি হলে অকৃষি ক্ষেত্রে সেই বৃদ্ধির পরিমাণ ৩৭ টাকা। গ্রামীণ অকৃষি ক্ষেত্রের মধ্যে এলাকাভিত্তিক বেশ কিছু আর্থিক কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। এর মধ্যে উল্লেখ করা যায় ইঁটভাটা, খাদান, ডেয়ারী, পোলট্রি, ভেরী প্রভৃতির কথা। বিভিন্ন এলাকায় এইগুলির কোনও কোনোটি সেই অঞ্চলের মূল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য হয়। এই সংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ হিসাব নিকাশ আলাদা একটি লেখার বিষয়, আগামীতে তা নিয়ে বাকবিস্তার করা যাবে।
সাম্প্রতিক কালে বিশেষ বিকাশ দেখা যাচ্ছে নিকটবর্তী বা দূরবর্তী গ্রাম বা শহরে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজের প্রবণতার। বস্তুতপক্ষে অকৃষি গ্রামীণ শ্রমজীবী জনগণের সবচেয়ে বড় অংশটাই আজ নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। তারা দিনান্তে, সপ্তাহান্তে বা কখনো কখনো বেশ কয়েক মাসান্তে ঘরে ফেরেন। কিন্তু তারা ও তাদের পরিবার গ্রামীণ অর্থনীতি রাজনীতির গুরূত্বপূর্ণ অঙ্গ। শহরাঞ্চলে নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন কাজের সঙ্গে গ্রামীণ রাজনীতির জল অচল সম্পর্ক এখন আর একেবারেই নেই। বরং ট্রেড ইউনিয়ন গণভিত্তিকে তার বসবাসের এলাকার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করার বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিকল্পনা বর্তমান গ্রামীণ রাজনৈতিক সাফল্যের অন্যতম শর্ত।
অকৃষি ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ বাড়লে কৃষিমজুরদের মজুরি বৃদ্ধির পথও অনেকটা সুগম হয়। আর্থিক দরকষাকষিতে ভূমিহীন গ্রামীণ শ্রমিক অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন। গ্রামীণ ক্ষেতমজুর সংগঠন ও অন্যান্য সংগঠন যারা আশা, অঙ্গনওয়ারী কর্মী, মিড ডে মিল কর্মী বা পার্শ্বশিক্ষকদের মজুরী/সম্মান দক্ষিণা বাড়ানোর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও ঐক্য বর্তমান গ্রামীণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রের অন্যতম বাস্তবতা। এন আর ই জি এ প্রকল্পের যথাযথ রূপায়ণও প্রত্যক্ষে পরোক্ষে ক্ষেতমজুরদের মজুরী বৃদ্ধির এই কাজটা করতে সক্ষম হতো, কিন্তু গ্রামীণ বড় জোতের মালিক নিয়ন্ত্রিত পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা ও সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রশাসনিক কাঠামো তাকে স্বাভাবিক কারণেই সফলভাবে রূপায়ণ করতে যত্নবান নয়। স্বাভাবিক ভাবেই একশো দিনের কাজ, তার অপ্রাপ্তি দুর্নীতি নিয়ে আন্দোলনের নানা দিক গ্রামীণ রাজনীতির অন্যতম জীবন্ত বিষয় হিসেবে গণ্য হয়।

No comments: