Tuesday, October 2, 2018

বিশ্ব রাজনীতিতে লাতিন আমেরিকা ও একুশ শতকের সমাজতন্ত্র


সমকালীন রাজনৈতিক আলোচনায় লাতিন আমেরিকা নিঃসন্দেহে একটি গুরূত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছে। সেখানে শোনা যাচ্ছে ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের’ কথা। কিউবার চে ফিদেলের পর ভেনেজুয়েলার স্যাভেজ, বলিভিয়ার ইভো মোরালেস বা ব্রাজিলের লুলা লাতিন আমেরিকার গণ্ডী ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের রাজনৈতিক মহলের চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছেন। সাম্প্রতিক মন্দা ও বিপর্যয়ের আগে সারা পৃথিবীতে যখন নব্য উদার অর্থনীতি-রাজনীতির প্রবল দাপট, সে সময়েই লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এক অন্য রাজনীতির প্রাধান্য আমরা লক্ষ্য করছি। ১৯৯৮ সালে ভেনেজুয়েলার নির্বাচনে প্রথম বারের জন্য বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি হন হুগো স্যাভেজ। এর পরে বিভিন্ন নির্বাচনে পরপর চারবার বিজয়ী হয়ে তিনি গোটা লাতিন আমেরিকার বামমুখী পটপরিবর্তনের অন্যতম কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর উত্তরসূরী মাদুরোকে মার্কিন মদতপুষ্ট দক্ষিণপন্থী প্রার্থী পরাস্ত করতে পারেন নি। নবনির্বাচিত ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো স্যাভেজের একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। কিউবা এবং ভেনেজুয়েলার পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার নানা দেশে আমরা গত এক দশকে বিভিন্ন মাত্রার বামঝোঁক সম্পন্ন সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে দেখছি। ২০০২ সালে চিলেতে রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে বিজয়ী হন রিকার্ডো লাগোস, ব্রাজিলে লুলা। ২০০৩ সালে আর্জেন্টিনার নির্বাচনে বিজয়ী হন নেসটর কির্কনার, উরুগুয়েতে ২০০৫ সালে নির্বাচনে জেতেন তাবারে ভাজকুয়েজ। ২০০৬ সালে চিলেতে মিশেল বাশালেত, বলিভিয়ায় ইভো মোরালেস, ইকুয়েডরে রাফায়েল কোরেয়া ও নিকারাগুয়ায় ড্যানিয়েল ওর্তেগা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে আর্জেন্টিনায় ক্রিস্টিনা ফের্নানদেজ ও গুয়েতমালায় আলভারো কলোম রাষ্ট্রপতি পদে বসেন। প্যারাগুয়েতে ২০০৮ সালে ফের্নাদো লুগা এবং এল সালভাদোরে ২০০৯ সালে মরিসিও ফুয়েনেস রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সে বছরই ইকুয়েডরে রাফায়েল কোরেয়া ও বলিভিয়ায় ইভো মোরলেস দ্বিতীয় বারের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। উরুগুয়েতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন হোসে মুজিকা।
ধারাবাহিক ভাবে মহাদেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক দেশে বামঝোঁক সম্পন্ন সরকার গঠনের বিষয়টি লাতিন আমেরিকার নিজস্ব ইতিহাসের দিক থেকে যেমন গুরূত্বপূর্ণ, তেমনি তাৎপর্যবাহী সমকালীন বিশ্ব রাজনৈতিক শক্তি বিন্যাসের দিক থেকেও। সাম্রাজ্যবাদী অক্ষের নিষ্পেষণে বহুদিন থাকার পর লাতিন আমেরিকা সমাজবাদী-জাতীয়তাবাদী রাজনীতি অর্থনীতির মধ্যে নিজেকে যেমন আবিষ্কার করছে, তেমনি নব্য উদার অর্থনীতি প্রধান বিশ্বে তা এক ভিন্ন স্বরকেও ক্রমশই সামনে তুলে আনছে। গত শতাব্দীর শেষ দুই দশক ধরে সোভিয়েত ধাঁচের সমাজের পতন, চিনে বাজার অর্থনীতি ও পুঁজির আরো বিস্তার, আর তারই উল্টোদিকে মুক্ত পুঁজির অবাধ গতিবিধির প্রেক্ষিতে উঠে আসা পুঁজিবাদের বিকল্পহীনতার তত্ত্বায়ন যখন ঘটছে (ফুকিয়ামা কথিত দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ জাতীয় কথা পাঠকের মনে পড়বে), তখন লাতিন আমেরিকা জুড়ে এই ভিন্ন স্বরের রাজনীতির আত্মপ্রকাশই তার প্রতি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছে।
লাতিন আমেরিকা জুড়ে ঘটে চলা এই সাম্প্রতিক রাজনীতির গতি প্রকৃতি অবশ্যই নিহিত আছে লাতিন আমেরিকার ইতিহাসের মধ্যে। এই মহাদেশ তার দীর্ঘ ইতিহাসের পর্বে বারবার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন আর তার বিরুদ্ধে ভূমিপুত্রদের তীব্র লড়াইকে প্রত্যক্ষ করেছে। মার্কস আর এঙ্গেলস ইউরোপে যখন কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের নির্দেশিকা তৈরি করছেন, তার বেশ কয়েক দশক আগেই উনিশ শতকের প্রথমভাগে নিজেদের মত করে লাতিন আমেরিকা জুড়ে স্পেনীয় –পর্তুগীজ উপনিবেশের হাত থেকে মুক্তির সফল লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাইমন বলিভার বা রডরিগেজ। পরবর্তীকালে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে আবার নয়া উপনিবেশ গড়ে ওঠে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দক্ষিণের দেশগুলির ওপর অর্থনৈতিক রাজনৈতিক আধিপত্য চাপিয়ে দেয়। ইতোমধ্যে বিশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে মার্কসবাদ সোভিয়েত রাশিয়া, চিন, পূর্ব ইউরোপ সহ দুনিয়ার এক বড় ভূখণ্ডে সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সফল মতাদর্শ হিসেবে মুক্তিদিশারী হয়ে উঠেছে। এর ওপর ভর করে কিউবায় মার্কিনপন্থী সরকারকে উচ্ছেদ করে নতুন শাসন ব্যবস্থার দিকচিহ্ন স্থাপন সম্ভব হয়েছে। বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে উঠেছে বলিভিয়া, নিকারাগুয়া, চিলে বা লাতিন আমেরিকার অন্যত্র। আজকের দিনে স্যাভেজ এবং অন্যান্য যে সমস্ত নেতৃবৃন্দ লাতিন আমেরিকার বাম মনস্ক রাজনীতিকে পথ দেখিয়েছেন, তারা সাইমন বলিভারের মত স্বকীয় আন্দোলনের ধারার সঙ্গে মার্কসবাদের মত বিশ্বজনীন মতাদর্শর সৃজনশীল সংশ্লেষ ঘটাতে চেয়েছেন, যা চিহ্নিত হয়েছে ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্র’ নামে।
লাতিন আমেরিকার রাজনীতির বিচার বিশ্লেষণে অনেকেই কিছু কষ্টিপাথর আগে স্থির করে তারপর তাকে কতটা প্রগতিশীল, কতটা আপোষকামী – সেই বিচার করতে বসেন। তাদের অনেকের মাথাতেই থেকে যায় সমাজতন্ত্রের কোনও মডেল। সেটা লেনিনের রাশিয়ার হতে পারে বা মাওয়ের চিনের। কিন্তু আজকের দিনে যারা চলমান রাজনীতির ভাষ্যকার, বা বিশেষ করে ফলিত রাজনীতির কারবারি, তাদের কাছে এ ধরণের মডেল নির্ভর বিচার বিশ্লেষণ খুব বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হবার কথা নয়। আজকের দিনে সারা পৃথিবীতে নতুন করে যখন বিভিন্ন ধরণের পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলন জন্ম নিচ্ছে, সে মার্কিন দেশে অকুপাই আন্দোলনই হোক বা ইউরোপ জোড়া কৃচ্ছসাধন নীতি বিরোধী আন্দোলন বা লাতিন আমেরিকায় নিও লিবারাল মডেলের তীব্র বিরোধিতা – তখন তার মধ্যে সমাজতন্ত্রের মৌলিক কিছু স্বপ্নকে আমরা পুনরুত্থিত হতে দেখি। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরণের মত ও পথের লোক আছেন। তাদের মতামতের মধ্যে ঐক্য ও সংগ্রামের এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্কও আছে। ঐক্য ও সংগ্রাম মিলিয়েই তারা একটা শিবিরের অংশ। পরিস্থিতিটা অনেকটা প্রথম আন্তর্জাতিকের সময়কার মতো। সেই সময় কমিউনিস্টরা অনেক অমার্কসবাদীদের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে ছিলেন প্রথম আন্তর্জাতিকের মধ্যে। তাদের মধ্যে পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের মত ও পথ নিয়ে ঐক্য ও সংগ্রামের এক সম্পর্কই বর্তমান ছিল। আজকের দিনে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নতুন পরিস্থিতি ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ লাতিন আমেরিকার বাম ঝোঁক সম্পন্ন জনপ্রিয় আন্দোলন ও সরকারগুলিকে দেখা দরকার, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার রক্তচাপকে ক্রমশ বাড়িয়েই চলেছেন নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ কার্যকলাপ, সংঘর্ষ – আপোষের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে। গোটা বিশ্বে, এমনকী লাতিন আমেরিকার দেশে দেশেও পুঁজিবাদের বিকাশ যেখানে এত অসম, সেখানে পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইও যে বহু বৈচিত্র্যে, বহু নিজস্বতাতেই শোভিত হবার কথা, সেই মৌলিক বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা সাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতিতে লাতিন আমেরিকার বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণে প্রবেশ করতে চাই।
সাম্প্রতিক সময়ে স্যাভেজের নেতৃত্বে ভেনেজুয়েলার যে পরিবর্তনের কাহিনী তা আমরা এই সংকলনেই আরেকটি লেখায় বিস্তারিত ভাবে বলেছি। তাছাড়া সাম্প্রতিক কালে বাংলায় ভেনেজুয়েলা ও স্যাভেজ নিয়ে বেশ কিছু গুরূত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যেই ফারুক চৌধুরী ও পার্থসারথি দাশগুপ্তর বই দুটির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার। কিউবা – তার নায়ক ফিদেল, চে কে নিয়ে অতীতে বর্তমানে বাংলায় বিভিন্ন ধরণের প্রচুর লেখা বেরিয়েছে, যার অনেকটা অংশই সহজলভ্য। এই সংকলনেই চে কে নিয়ে রয়েছে আমাদের আলাদা একটি লেখা। নিকারাগুয়া নিয়ে ‘মুক্ত নিকারাগুয়া’ নামে সুমনের একটি আস্ত বইই আছে। ব্রাজিলের লুলা সরকার নিয়ে একটি ছোট বইতে খুব আলোকসম্পাতী কিছু চর্চা করেছেন অধ্যাপক কুণাল চট্টোপাধ্যায়। লাতিন আমেরিকার শোষণের দীর্ঘ সামগ্রিক ইতিহাস নিয়ে এদুয়ার্দো গালেয়ানোর বিখ্যাত বই  ‘ওপেন ভেইনস অব লাতিন আমেরিকা’ -র একটি বাংলা অনুবাদ করেছেন অশেষ রায়। ‘লাতিন আমেরিকার রক্তাক্ত ইতিহাস’ নামের সেই বইটি এই সংক্রান্ত চর্চায় অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের, বিশেষত বামপন্থী সংগঠনগুলোর পত্রপত্রিকায় লাতিন আমেরিকা নিয়ে বেশ কিছু গুরূত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত জন বেলামি ফস্টার সম্পাদিত ‘মান্থলি রিভিউ’ এর পাতায় প্রকাশিত লাতিন আমেরিকা সংক্রান্ত বেশ কিছু জরুরী লেখার অনুবাদ আশিষ লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাংলা মান্থলি রিভিউ’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে জন বেলামি ফস্টারের প্রাককথন সহ মার্তা হার্নেকর এর একটি অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ বই এর অনুবাদও রয়েছে – ‘লাতিন আমেরিকা : ভ্রান্তি এড়াতে নতুন পথের সন্ধান’।  আগ্রহী পাঠক নিশ্চয় এগুলির সাথে পরিচিত হতে চাইবেন। বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা বেছে নিচ্ছি প্রতিনিধিস্থানীয় চারটি দেশ, সেখানকার গণআন্দোলন ও সেইসূত্রে নির্বাচিত বাম ঝোঁক সম্পন্ন সরকারগুলিকে - যা লাতিন আমেরিকার সাম্প্রতিক রাজনীতির বৈচিত্র্যপূর্ণ অবস্থানটিকে তুলে ধরে। এগুলি হল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া ও ইকুয়েডর। আগেই বলেছি চে ও কিউবা এবং স্যাভেজ ও ভেনেজুয়েলা নিয়ে আমাদের আলাদা দুটি লেখা এই সংকলনেই আছে, তাই এই লেখায় সে প্রসঙ্গ পুনরালোচিত হল না।
ব্রাজিল লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় দেশ। কি আয়তনে, কি জনসংখ্যায়। রাশিয়া, চিন ও দক্ষিণ আমেরিকার পাশাপাশি এই দেশটি ভারতের সঙ্গে এক বিশেষ সম্পর্কেও যুক্ত। এই দেশগুলি নিয়ে গঠিত ব্রিকস আগামীদিনে বিশ্ব রাজনীতির গুরূত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক বলে অনেকেই মনে করেন। ব্রাজিলের রাজনীতিতে ১৯৮০ আর ৯০ এর দশকে শ্রমিক দলের উত্থান সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছিল। স্বৈরতন্ত্র বিরোধি আন্দোলন থেকে এই দলের জন্ম হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা লুলা। শ্রমিক দলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল খুবই আকর্ষণীয়। বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে এই দলটি গড়ে তুলেছিলেন। এদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন বিভিন্ন মার্কসবাদী ও ট্রটস্কীবাদী ধারার লোকেরা। ক্রীশ্চান সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন। প্রত্যেকটি ধারার নিজেদের সংগঠন, পত্রপত্রিকা রাখার অধিকার ইত্যাদি ছিল।
শ্রমিক দল কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার আগে পৌর বা রাজ্য স্তরে ক্ষমতা পেয়েছিল ও সেখানে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রর ভালো কিছু নজির দেখিয়েছিল। যেমন বাজেটের টাকা ব্যয় নিয়ে স্থানীয় বক্তব্য গুরূত্ব পেত। কয়েকবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পরাজিত হবার পর ২০০২ সালে লুলা প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ও শ্রমিক দল কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার জন্য এক ধরণের স্যোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর দরকার হয়েছিল। শ্রমিক ক্ষেত মজুরের ভোট নিশ্চিত বোঝার পর লুলা সমাজের অন্য অংশের ভোটকে নিশ্চিত করতে চান। এজন্য তিনি জোটসঙ্গী করেন বড় পুঁজিপতি ও উদারপন্থী দলের নেতা জোসে আলেনকারকে। লুলা ও শ্রমিক দল ক্ষমতায় এলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় ধরণের উদ্দীপণা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাদের আশা পূরণ হয় নি। লুলা চার বছরের মধ্যে মজুরী দ্বিগুণ করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তা হয় নি। বড় জমিদারী বাজেয়াপ্ত করা হয় নি। তার বদলে জোর দেওয়া হয়েছে বড় জমিদারীর মাধ্যমে রপ্তানীমুখী কৃষি উৎপাদনের ওপর। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার বোধহয় পেনশন সংস্কার আইন। এর মাধ্যমে পেনশনের জন্য উপযুক্ত হতে কাজের বছরের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে, পেনশন ফাণ্ডকে বেসরকারী ও বহুজাতিক ফাটকা পুঁজির হাতে খুলে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কৃষি সম্পর্কের ক্ষেত্রে শ্রমিক দলের সরকার আগের দক্ষিণপন্থীদের থেকে ভিন্ন পথে হেঁটেছে এবং তার ‘বাম ঝোঁক’ বজায় রেখেছে। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের তীব্র বিরোধিতা করেছিল লুলার সরকার। আমেরিকার ‘অবাধ বাণিজ্য এলাকা’র (এফ টি টি এ) গঠনের বিরুদ্ধে ব্রাজিল কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং কালক্রমে স্যাভেজ তথা ভেনেজুয়েলার নেতৃত্বাধীন মার্কিন বিরোধী ‘আলবা’র জোটে যোগ দিয়েছে। ব্রাজিলের তথা শ্রমিক দলের ভূমিকা ও ঝোঁক এই অঞ্চল তথা বিশ্বে চলমান রাজনৈতিক শক্তি ভারসাম্যর ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে।
আর্জেন্তিনার জমানা বদলের ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই ভূমিকা রেখেছে রাস্তার লড়াই। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি ডি লা রুয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছড়ে পড়ে। জনতা ও পুলিশের যুদ্ধে তিনদিনে আটত্রিশ জন মারা যান। বেকার, অর্ধবেকার শ্রমিক আর মধ্যবিত্ত জনগণ রাস্তার দখল নেন। দেশের সমস্ত বড় বড় রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। চার কোটি জনসংখ্যার দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। পরপর তিনজন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসেন আর যান। বিচারব্যবস্থা, পুলিশ-সেনাবাহিনী, আর প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি জনগণের বিশ্বাস তলানিতে গিয়ে পৌঁছায়। কির্কনার রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছিল। কির্কনার জমানায় নয়া উদারবাদের ভিন্নপথে হেঁটে বেকারত্মের হার ও দারিদ্রের মাত্রাকে বেশ কিছুটা কমিয়ে আনা হয়। সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কির্কনারের সরকার ব্যয়বরাদ্দ অনেকটা বৃদ্ধি করে, বাসস্থান সমস্যার সুরাহা করে, বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণা ও শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ায়, পরিকাঠামো ক্ষেত্রেও অনেক বিকাশ ঘটানো হয়। সেনাবাহিনীর মধ্যেও বেশ কিছু গুরূত্বপূর্ণ সংস্কার সাধিত হয়। সেনাবাহিনীর কার্যকলাপকে অনেক বেশি স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ করে তোলা হয়। ২০০৭ সালের নির্বাচনে স্ত্রীর হাতে দায়িত্ব তুলে দেন কির্কনার। এই ২০০৭ এর নির্বাচনেই আর্জেন্টিনার ইতিহাসে প্রথম কোনও সমাজতান্ত্রিক গভর্নর হিসেবে বিজয়ী হন ‘সান্তা ফে’ থেকে জেতা হারমেস বিন্নার।
নেস্টর কির্কনারের পর রাষ্ট্রপতি হয়ে তার স্ত্রী ক্রিস্টিনা কির্কনার সংস্কারকে খানিকটা উলটোমুখে প্রবাহিত করার চেষ্টা করলে রাস্তার লড়াই আবার সামনে আসে। কৃষি রপ্তানীর ক্ষেত্রে নতুন কর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই ক্ষেত্রে ১২৯ দিন ব্যাপী ব্যাপক ধর্মঘট চলে। শেষপর্যন্ত সেনেট নতুন করবিধি বাতিল করতে বাধ্য হয়। জনগণের নজরদারি ও সক্রিয়তা গত এক দশকে আর্জেন্টিনিয় শাসকদের দেশের বুনিয়াদী সমস্যার প্রতি মনযোগী থাকতে বাধ্য করে চলেছে, যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন দিকচিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হবার দাবি রাখে।
ইকুয়েডরের রাজনীতি ২০০৭ সাল থেকে এক নতুন মোড় নেয় আর এই বাঁক পরিবর্তনের প্রধান কাণ্ডারী রাষ্ট্রপতি রাফায়েল কোরেয়া। রাষ্ট্রপতি হবার আগে পূর্বতন আলফ্রেডো প্যালাসিও সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি ২০০৫-০৬ সালে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। কিন্তু এই সময়পর্বে দেশের আর্থিক নীতিমালার প্রশ্নে তার সঙ্গে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি প্যালাসিওর বিরোধ তৈরি হয়। মূলত আমেরিকার সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এই বিরোধের কারণ ছিল, যে চুক্তি কোরেয়া মেনে নিতে পারেন নি। সেইসঙ্গে আই এম এফ এর নীতিমালা মেনে চলতেও তিনি রাজী ছিলেন না। পরিবর্তে অন্যান্য লাতিন আমেরিকার দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আর্থিক সহযোগ স্থাপনে তার আগ্রহ ছিল। তেল সংক্রান্ত নীতিমালা বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্বব্যাঙ্ক একটি ঋণ প্রদান স্থগিত করে দেওয়ায় তিনি অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। রাষ্ট্রপতি তাকে আর্থিক নীতির প্রশ্নে সহযোগ দিচ্ছেন না, এরকমই ছিল কোরেয়ার অভিযোগ।
২০০৬ এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোরেয়া প্রার্থী হন। তার জোটসঙ্গীদের মধ্যে ছিল ইকুয়েডরের সোস্যালিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইকুয়েডর, ডেমোক্রেটিক লেফট, ডেমোক্রেটিক পিপলস মুভমেন্ট এবং আরো কিছু গোষ্ঠী। নির্বাচনী প্রচারে কোরেয়া ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্র’র কথা বলেন, প্রস্তাব রাখেন একটি নতুন সংবিধান সভার মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনার। মূলত তেলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ইকুয়েডরের তেলনীতিকে বদলে ফেলার কথা বলেন তিনি, যেখানে পেট্রোলিয়াম থেকে আসা রাজস্ব আরো বেশি পরিমাণে দেশের গরীবদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে ব্যয় করার পরিকল্পনা ঘোষিত হয়। এই সময়ের এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন পাঁচ ব্যারেল তীর চার ব্যারেলই তখন প্রায় বহুজাতিক তৈল উৎপাদনকারীদের ভাগে চলে যেত, দেশের জন্য পড়ে থাকত এক ব্যারেল মাত্র। এই তেল নীতিকে তিনি ঠিক উলটো মুখে ঘোরাতে চান। জাতীয় ঋণ পরিশোধের চেয়ে সামাজিক সুরক্ষার দিকেই জোর দেবার কথাও তিনি বলেন।
বুঝতে অসুবিধা ছিল না কোরেয়া কোন রাজনৈতিক নীতির পথিক এবং এই নীতিতেই আস্থাশীল থেকে ইকুয়েডর বাসী তাকে পরপর তিনবার রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করেন (২০০৬, ২০০৯, ২০১৩)। রাষ্ট্রপতি হবার পর তিনি পরিস্কার জানিয়ে দেন আই এম এফ কে কোনওভাবেই আর্থিক নীতিমালা রচনায় প্রভুত্ব করতে দেওয়া হবে না। বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও কোরেয়া পূর্বতন শাসকদের আমেরিকান ছত্রছায়ায় থাকার নীতি থেকে উলটোমুখে সরে আসেন এবং ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, কিউবার মত প্রতিবেশী এমনকী ইরানের মত দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। ২০০৯ সালে পূর্ব চুক্তি শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই এলয় আলফারোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে বিমান ঘাঁটি ছিল, তার নবীকরণ বাতিল করা হয় । সাম্প্রতিক কালে মার্কিন –ব্রিটিশ অক্ষের সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির বহুল তথ্য উন্মোচক উইকিলিকস প্রধান জুলিয়ান আস্যাঞ্জকে ষড়যন্ত্রমূলক গ্রেপ্তারী থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে তাঁকে ব্রিটেনের ইকুয়েডর এমব্যাসিতে দিনের পর দিন আশ্রয় দান করে কোরেয়া তার অনড় বলিষ্ঠ বিদেশ নীতির আর একটি পরিচয় দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি হবার পরেই সামাজিক নীতিমালাতে কোরেয়া ব্যাপক রদবদল করেন। সামাজিক খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ে ১৫.৪৪ শতাংশ। গরীবদের গৃহনির্মাণ খাতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। ২০০৯ এ দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবার পর তিনি জানিয়েছিলেন, ‘সমাজতান্ত্রিক নীতিমালা প্রবহমান থাকবে। ইকুয়েডরের মানুষ সে লক্ষ্যেই ভোট দিয়েছেন। আমরা সামাজিক ন্যায় ও আঞ্চলিক ন্যায়ের প্রশ্নে জোর দেব। কাজের ক্ষেত্রে সমস্ত ধরণের শোষণ মুক্তির জন্য আমাদের লড়াই জারী থাকবে। পুঁজির ওপরে স্থান পাবে মানুষের শ্রম। কারোর কোনও সন্দেহ যেন না থাকে যে দরিদ্রতম লোকেদের জন্যই আমাদের কাজ। তাদের জন্যই আমরা এখানে এসেছি। লড়াই চলবে, যতদিন না বিজয় আসে’। এই বক্তব্যকেই কোরেয়া ও তার সরকারের নীতিমালার সার হিসেবে গ্রহণ করা যায়, বোঝা যায় তার নীতি ও কাজের অভিমুখ, যে কাজ এখনো চলমান।
বাম ঝোঁক সম্পন্ন লাতিন আমেরিকার সরকারগুলির আলোচনায় সব শেষে আসা যাক বলিভিয়ার প্রসঙ্গে। বলিভিয়া সেই দেশ যাকে মুক্ত করতে গিয়ে শহীদের মৃত্যু বরণ করেছিলেন চে গেভারা। চে’র বলিভিয়ার ডায়েরী তো আজ মুক্ত দুনিয়ার স্বপ্নদর্শী মানুষের অন্তঃহীন প্রেরণা। কিন্তু বলিভিয়া শুধু শহীদের সেই থেমে যাওয়া বিপ্লবের প্রচেষ্টার সূতিকাগার হিসেবেই আজ আর শুধু আলোচিত নয়। সেখানে এখন লেখা হচ্ছে নতুন ইতিহাস। মানুষের মুক্তির নতুন ইতিহাস, যে ইতিহাসের স্বপ্ন ছিল চে’র রক্তে, মননে, মজ্জায়। আর এই নতুন দিন বদলের অন্যতম কাণ্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ রাষ্ট্রনায়ক ইভো মোরালেস, যিনি ২০০৫ এর নির্বাচনে জিতে প্রথমবারের জন্য ক্ষমতায় আসেন ও এর পরে আরো দুবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পরপর বিজয়ী হন।
প্রত্যেক নতুন ইতিহাস তৈরির পেছনে থাকে তার প্রেক্ষাপট। মোরালেসের বলিভিয়াকে বুঝতে সেই প্রেক্ষাপটটা জানা জরুরী। স্পেনীয় শাসন থেকে মুক্তির পর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে উনিশ শতক জুড়ে বলিভিয়া কিছু সীমান্ত সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে এবং তার ভূখণ্ড ও সেইসূত্রে প্রাকৃতিক সম্পদের বেশ কিছু আকর হারায়। বিশ শতকের প্রথম পর্ব থেকে বলিভিয়ায় অর্থনৈতিক বিকাশ ও তার হাত ধরে রাজনৈতিক সুস্থিতি আসতে থাকে, প্রথমে মূলত খনির সোনা ও পরে টিন এর ওপর নির্ভর করে। অষ্টাদশ শতকের ফরাসী ফিজিওক্রাটদের পরামর্শ নির্ভর লেসঁ ফেয়ার নীতি অবলম্বন করে এ সময়ের সরকারগুলো চলতে থাকে, যার মূল দর্শন ছিল অর্থনৈতিক বিষয়ে রাষ্ট্র খুব একটা হস্তক্ষেপ করবে না, ব্যক্তি উদ্যোগই বেশি প্রাধান্য পাবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও তা সীমাবদ্ধ ছিল সমাজের এলিট শ্রেণির হাতেই। সামন্তপ্রথা কৃষিক্ষেত্রে জাঁকিয়ে বসেছিল, খনি শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও আর্থিক অবস্থা ছিল দূর্বিষহ।
বিশ শতকের প্রথম ত্রিশ বছর একটা রাজনৈতিক সুস্থিতির পর বিরাট আর্থিক অসাম্য ও মূলত পিছিয়ে পড়া মানুষদের ব্যাপক বঞ্চনার সূত্রে দানা বাঁধে বিপ্লবী জাতিয়তাবাদী আন্দোলন ( রিভোলিউওশনারি ন্যাশানালিস্ট মুভমেন্ট বা MNR )। ১৯৫২ সালে এম এন আর ক্ষমতা দখল করে, রাষ্ট্রপতি হন ভিক্তর পাজ। পাজ লেসঁ ফেয়ার নীতি থেকে সরে এসে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেন, পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সংস্কার সাধিত হয়। এই সময়েই চালু হয় সর্বজনীন ভোটাধিকার। ব্যাপক ভূমিসংস্কার কর্মসূচী গৃহীত হয়, গ্রামীণ জনগণের শিক্ষার বিকাশে বিশেষ জোর দেওয়া হয় আর অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে টিনের খনিগুলির জাতীয়করণ করা হয়।
বলিভিয়ার ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আর লেসঁ ফেয়ার নীতির দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। এম এন আর শাসনের বারো বছরের মাথায় দেশে একটি প্রতিবিপ্লবী ক্যুর মধ্য দিয়ে মিলিটারি জুন্টা ক্ষমতা দখল করে। এই মিলিটারি শাসনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ। এই জুন্টার শাসনকালেই চে গেভারা গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বলিভিয়া মুক্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, ধরা পড়েন এবং তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মিলিটারি জুন্টার পরে বেশ কিছু অস্থায়ী সরকার কিছুদিনের জন্য শাসন করে, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক সুস্থিতি ছিল অধরা। নব্বইয়ের দশকে গঞ্জালো স্যাঞ্জেজ নয়া উদারবাদ নির্দেশিত নীতির ভিত্তিতে দেশ চালানো শুরু করেন।  রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির পঞ্চাশ শতাংশ পর্যন্ত মালিকানা ও পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বিদেশী। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি বেনজারের সরকারও একইভাবে নয়া উদারবাদী নীতি গ্রহণ করে। অন্যান্য বিভিন্ন নীতির সঙ্গে কোকো উৎপাদন বন্ধের একটি বিশেষ নীতি এই সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং সেই বিক্ষোভ আন্দোলনের প্রধান কাণ্ডারী ইভো মোরালেসকে গণ আন্দোলনের ওপর ভর করে আমরা ২০০৫ সালে বলিভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ক্ষমতায় আসতে দেখি।
বলিভিয়ার একটি প্রধান কৃষিপণ্য হল কোকো। এটি ওষুধ তৈরির উপকরণ হিসেবে জরুরী, আবার বলিভিয়ার অনেক অঞ্চলে এটি সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই কোকোকেই আবার অনেকে ব্যবহার করেন মাদক কোকেন তৈরির কাজে। মূলত মাদক কোকেন এর ব্যবহার বন্ধ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের নির্দেশে বলিভিয়ার এই পর্বের মার্কিন অনুগত সরকার  কোকো উৎপাদনকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। রুটি রুজির প্রধান অবলম্বন কেড়ে নেওয়ার এই স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে কোকো উৎপাদনকারীরা পথে নামেন। মূলত কোকাবাম্বা অঞ্চলে বিক্ষোভ তীব্রতম চেহারা নেয়, কারণ এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই কোকা উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। কোকা উৎপাদন কতটা জনপ্রিয় ছিল তা বোঝা যাবে কোকাম্বার অন্তর্গত এল চাপারে প্রদেশের জনগণনার হিসেব থেকে। ১৯৮১ সালে এল চাপারের জনসংখ্যা ছিল ৪০,০০০। ১৯৯৮ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ২,১৫,০০০ এ। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বলিভিয়ানরা দলে দলে এখানে আসেন কোকা উৎপাদনের আগ্রহে, যার দাম ছিল ক্রমশই উর্ধমুখী আর বছরে চারবার যার চাষ করা সম্ভব ছিল। ইভো মোরালেসের পরিবারও পরিযায়ী হয়ে এখানে আসেন এবং মোরালেস কোকা উৎপাদকদের ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৮০ তে চরম দক্ষিণপন্থী লুই গার্সিয়া ক্ষমতা দখল করেন এবং ১৯৮১ থেকে কোকেন পাচারের অভিযোগে কোকো উৎপাদকদের ওপর সেনাবাহিনীর অত্যাচার শুরু হয়। ১৯৮২ তে বামপন্থী হারমান জুয়াজোর সরকার ক্ষমতায় আসে কিন্তু তারাও দ্রুত আমেরিকি চাপের কাছে নতিস্বীকার করে। কোকা উৎপাদন বন্ধে বলিভিয় সরকারকে সাহায্যের জন্য আমেরিকা সেনাবাহিনী পর্যন্ত পাঠায়। কোকা উৎপাদনের প্রশ্নটি ক্রমশই বলিভিয়ার সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায় এবং মার্কিনীদের দেখা হতে থাকে সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে। কোকা উৎপাদকদের ইউনিয়ন সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করবে কিনা এ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের পর অবশেষে তারা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কোকা উৎপাদকদের নেতা হিসেবে মোরালেসকে অনেকবার জেল খাটতে হয়েছে, ১৯৮৯ সালে তাকে একবার প্রচণ্ড মারধোর করে মরণাপন্ন করে তোলা হয়।
মোরালেস কোকাকে আন্ডেন সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন এবং কোকা ও কোকেনের পার্থক্যকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য প্রচার অভিযানে সামিল হন। কোকা উৎপাদকদের নিয়ে কোকাকাম্বা থেকে বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজ পর্যন্ত ৬০০ কিমি দীর্ঘ রাস্তা তিনি পাড়ি দেন। ইউরোপে প্রচারে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ আমি ড্রাগ পাচারকারী নই। আমি কোকা উৎপাদক। এটা একটা প্রাকৃতিক সম্পদ। আমি তা থেকে কোকেন বানাই না। কোকেন আন্দিয়ান সংস্কৃতির অঙ্গ নয়”। ১৯৯৫ থেকে মোরালেস তাঁর আন্দোলনকে অভিহিত করেন ‘মুভমেন্ট ফর সোস্যালিজম’ নামে।
কোকা উৎপাদক অঞ্চল থেকে তিনি সংসদে নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০০২ সালে কোকা উৎপাদকদের ওপর সেনা আক্রমণ হলে তিনি খোলাখুলি উৎপাদকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের কথা বলেন। এজন্য সংসদ থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। এই বছরেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করন এবং দেশের রাজনৈতিক মহলে বিষ্ময় তৈরি করে দ্বিতীয় স্থান পান। গোটা লাতিন আমেরিকা জুড়ে মূলবাসী স্বাদেশিক আন্দোলনের অন্যতম কন্ঠস্বর হিসেবে মোরালেসের পরিচিতির শুরুও হয় এই সময় থেকেই।
কোকা উৎপাদনের স্বপক্ষে ও নয়া উদারবাদী নীতির বিরোধিতায় মোরালেসের আন্দোলন চলতে থাকে। ২০০৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মোরালেস বিপুল সমর্থন নিয়ে বিজয়ী হন এবং এই বছরেই পালিত হয় ‘মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজম’ এর দশম বর্ষপূর্তি। আদিবাসী মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও তার আন্দোলন অবশেষে মোরালেসের রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে সাফল্য পায়। অভিষেক ভাষণে মোরালেস জানান ‘ ৫০০ বছরের ঔপনিবেশিকতার অবসান হলো’। দেশের পুনর্গঠনের কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন পরবর্তীকালে নিষ্ঠার সঙ্গে কর্পোরেট লবি ও তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার তুমুল বিরোধিতা স্বত্ত্বেও সে কাজ তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। মোরালেসের মন্ত্রীসভায় আদিবাসী মানুষ ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের আধিক্য প্রথম থেকেই তাঁর দৃষ্টিকোণ স্পষ্ট করে দিয়েছিল। মোরালেস সরকার প্রথমেই বলিভিয়ার ব্যাপক দারিদ্রের প্রকোপ সীমায়িত করার দিকে নজর দেয়। প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই দারিদ্রসীমার হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২৭ শতাংশে নেমে আসে। অশিক্ষা দূরীকরণেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়। অনেক গুরূত্বপূর্ণ আর্থিক উৎপাদন ক্ষেত্রের জাতিয়করণ করা হয়, যার মধ্যে ছিল তেল, খনি, প্রাকৃতিক গ্যাসের পাশাপাশি যোগাযোগ ক্ষেত্র। সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক ব্যয় বরাদ্দ করা হয় সরকারের তরফে। বয়স্কদের পেনসনের ব্যবস্থা করা হয়, এজন্য আগে থেকে অর্থ প্রদানের কোনও প্রয়োজন ছিল না। শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও শিক্ষার জন্য মায়েদের বিশেষ ভাতা দেওয়া হয়। কৃষকদের শয়ে শয়ে ট্রাক্টর বিনে পয়সায় বিলি করা হয়। জ্বালানী ও খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হয়, খাদ্য রপ্তানীর পরিবর্তে স্থানীয় বাজারে খাদ্য বিক্রির ওপর জোর দেওয়া হয়। ভরতুকি মূল্যে খাদ্য সরবরাহের জন্য একটি সরকারী সংস্থাও গঠন করা হয়। ২০০৬ আহূত নতুন সংবিধান সভার মাধ্যমে তৈরি হয় নতুন সংবিধান এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে স্বীকৃতি দিয়ে তার নতুন নাম হয় ‘প্লুরিন্যাশানাল স্টেট অব বলিভিয়া’। ২০০৯ সালের নির্বাচনে আরো বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করেন মোরালেস, ভোটের শতাংশ মাত্রা ২০০৫ থেকে বেড়ে হয় ২০০৯। পুঁজিবাদ, নয়া উদারবাদ ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মোরালেস ও বলিভিয়ার সংগ্রাম সাম্প্রতিক সময়েও চলমান। লাতিন আমেরিকার সংগ্রামী বিপ্লবী রাজনীতিতে কাস্ত্রোর প্রজন্মের পরে, স্যাভেজের প্রয়াণের পরে, নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব হিসেবে ইভো মোরালেস এবং বলিভিয়ার প্রতি আগামী দিনে রাজনীতি সচেতন মানুষের বিশেষ আগ্রহ থাকবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

No comments: