Tuesday, October 2, 2018

নারী আন্দোলন :একালীন প্রেক্ষাপট


সারা পৃথিবীতে নারী আন্দোলন আজকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। তার অন্যতম কারণ গোটা দুনিয়ায় অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ জীবনের গতি – এক কথায় ইতিহাস এক ভাবে এগোয় নি। ইউরোপে নারীদের সমস্যা আর আফগানিস্থান বা পাকিস্থানে নারীদের সমস্যা এক নয়। আলাদা আলাদা ভূখণ্ডে আলাদা আলাদা লড়াইয়ের ইস্যু সামনে রয়েছে। নারী আন্দোলনের মৌলিক লক্ষ্যটা সব জায়গাতেই এক। সেটা সমানাধিকারের জন্য লড়াই। কিন্তু নারীদের সামাজিক অবস্থান বিভিন্ন দেশে এত আলাদা রকমের যে সব জায়গায় সেই মূল লক্ষ্য অর্জনের পথে অনেকগুলো লড়াই লড়ে নিতে হচ্ছে। যেমন আফগানিস্থান বা পাকিস্থানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তালিবানী হুমকির সামনে দাঁড়িয়ে মালালাদের লড়তে হচ্ছে  মেয়েদের স্কুলে যাবার, পড়াশোনার অধিকারের জন্য। সেখানে এইসব লড়াইকে পেরিয়ে, পাশ কাটিয়ে সরাসরি সমানাধিকারের লড়াই হতে পারে না। অন্যভাবে বলা যায় সমানাধিকারের লড়াই এর বহুস্তরিক ধাপগুলির নিতান্ত প্রাথমিক কিছু বিষয়কে অর্জন করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে এখানে সামনে আছে। নারী আন্দোলনকে এই প্রসঙ্গে সরাসরি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশভাগ করে দেখাটাও জরুরী। আমরা প্রথমে সেই লড়াইকে দেখতে চাইবো, তাকে থামিয়ে যারা দিতে চাইছে তাদের যুক্তিক্রম ও বক্তব্যও বুঝতে চাইবো। বুঝতে চাইবো সেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেহারাটা। এরপর আমরা দেখতে চাইবো ঠিক বিপ্রতীপ বলে কথিত, মুক্ত সমাজ দুনিয়া বলে নন্দিত আমেরিকার মেয়েদের লড়াইয়ের বর্তমান চেহারাটা। সেখানকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে উঠে আসা বিভিন্ন বক্তব্যে, প্রার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গীগত অবস্থানে নারীদের প্রশ্নটি কতটা প্রগতিশীল বা রক্ষণশীল প্রশ্ন নিয়ে থেকেছে, সেটা দেখে সেখানকার নারী অন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়ে আমরা ভাবতে চাইবো। নারী আন্দোলনকে সেখানেও গণতান্ত্রিক পরিসরের ব্যাপ্ত প্রেক্ষাপটের সূত্রেই দেখতে হবে। সবশেষে আমরা ভারতের সাম্প্রতিক কালের নারী আন্দোলনের সূত্রে দেখতে চাইবো নারী আন্দোলন কীভাবে আসলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম অক্ষ হয়ে এদেশে এবং এ রাজ্যেও দাঁড়িয়ে আছে। নারী আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন কীভাবে এক পারস্পরিক সম্পর্ক যুক্ত। আর এটা শুধু ভারতে নয়, আগগানিস্থান, আমেরিকা, ভারত সহ সর্বত্রই।
মালালা, তালিবান ও মুসলিম বিশ্বে নারী আন্দোলন
তালিবান কম্যাণ্ডার আদনান রাশিদ একটা চিঠি লিখেছেন মালালাকে। সেই মালালাকে যাকে তালিবানরা গুলি করেছিল তাদের নিষেধ অমান্য করে স্কুলে পড়তে  যাবার জন্য। মৃত্যুর মুখ থেকে সে ফিরে এসেছে, প্রথমে পাকিস্থানে ও তারপর দীর্ঘদিন ইংলণ্ডে চিকিৎসার পর। ইংলণ্ডে সে আবার ভর্তি হয়েছে স্কুলে, আর সেখান থেকেই সে জানাচ্ছে নারীদের শিক্ষার বিরুদ্ধে যাদের জেহাদ, তাদের উদ্দেশ্যে কঠোর চ্যালেঞ্জ। শত হুমকি উপেক্ষা করেই। তাকে নিয়ে প্রচারও যথেষ্ট বিশ্বজোড়া। এই প্রচারের প্রেক্ষিতে নিজেদের পক্ষ সমর্থন করে কলম ধরতে হয়েছে তালিবান কম্যাণ্ডার আদনান রাশিদকে। এই চিঠিটি বিশ্লেষণের সূত্রে আমরা বুঝে নিতে চাইবো পৃথিবীর এই প্রান্তে বা এই রকম প্রান্তগুলোতে নারী আন্দোলনের এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রশ্নগুলো আসলে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে।
আদনান রশিদের চিঠির ভাষা আকর্ষনীয় সুন্দর, উপস্থাপিত বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। যদিও চিঠিতে মাঝে মাঝে মহান আল্লার বিচারের ওপর অনেক কিছু ছেড়ে দেবার কথা আছে, কিন্তু পত্রলেখক তার নিজস্ব বিচারধারা প্রয়োগ করে যুক্তি দিয়েছেন, যুক্তির আলোয় অনেক কিছু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। মালালার প্রতি চিঠিতে প্রণীত অভিযোগগুলি সূত্রবদ্ধ করা যাক
১) মালালাকে শুধু স্কুলে যাবার জন্য/পড়াশুনো করার জন্য গুলি করা হয় নি। আরো হাজার হাজার মেয়ে এখানে স্কুলে যাচ্ছে, পড়াশুনো করছে। স্কুলও তালিবানরা একারণে উড়িয়ে দেয় নি, যে তারা মেয়েদের পড়াশুনোর বিরোধী। গোটা বিষয়টিকে দেখতে হবে একটি সমর কৌশলের অঙ্গ হিসেবে। আদনান রশিদ এর মতে স্কুল পাকিস্থানের আর্মিও উড়িয়ে দেয়, তালিবানিরাও ওড়ায়। গোটা ব্যাপারটা শিক্ষার বিরোধ সমর্থনের সঙ্গে যুক্ত নয়। আসলে স্কুলগুলি যুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, বিপক্ষ যাতে এই চলমান যুদ্ধে এই ঘাটির দখল নিতে না পারে, তাই স্কুল ওড়াতে হয়। মালালা এই বিষয়টি বোঝেন নি।
২) এই সমর কৌশলের বিষয়টি না বুঝে মালালা যে প্রচারে সামিল হয়েছেন তা তালিবানদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে। ইউরো আমেরিকানদের সাথে ইসলামিক দুনিয়ার যে যুদ্ধ (তালিবান/ইসলামিক জেহাদীদের হাত ধরে) চলছে তাতে মালালার অভিমত আরো বেশি বেশি করে কালো/বাদামী চামড়া আর ইউরোপীয় মননের মানুষের জন্ম দিচ্ছে। (আর তাতে ইউরোপ আমেরিকার সুবিধা হয়ে যাচ্ছে)।
৩) কালো/বাদামী চামড়া আর ইউরোপীয় মননের মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলার জন্যই ইউরোপীয়/ আমেরিকান মিডিয়া এইসব কাজ করছে। জাতিসঙ্ঘ মালালাকে সামনে রেখে প্রচারে সামিল হয়েছে।
৪) তালিবান আর ইউরো আমেরিকানদের লড়াইটা ঠিক কোথায়, সেটা পত্রলেখকের স্পষ্ট ভাষাতেই উল্লেখ করে দেওয়া প্রয়োজন, অনুবাদের প্রয়োজন নেই।
"The Taliban Want To Implement What Is In The Book Of ALLAH And UNO Want[s] To Implement What They Have In Man-Made Books; We Want To Connect The World To Its Creator Through The Book Of Allah And UNO Want[s] To Enslave The World"
৫) পত্রলেখকের জবানীতে পরিষ্কার কিরকম শিক্ষা তালিবানরা চান ও বিশ্বজুড়ে প্রচলিত আধুনিক শিক্ষাকে তারা কি চোখে দেখেন।
"You say a teacher, a pen, and a book can change the world; yes I agree with [this], but which teacher, which pen, and which book? It is to be specified [that] Prophet Muhammad, peace be upon him, said: I am sent as a teacher, and the book He sent to teach is the Quran. So a noble and pious teacher with prophetic curriculum can change the world, not with satanic or secular curriculum."
৬) ফলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় মালালার প্রতি তালিবান পত্রলেখকের কিরকম আহ্বান থাকে। মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ, মুসলিম উম্মার প্রতিষ্ঠার জন্য কলমকে ব্যবহার করা।
I advise you to come back home, to adopt the Islamic and Pushtoon culture, to join any female Islamic madrassa near your home town, to study and learn the book of Allah; to use your pen for Islam and [for the] plight of the Muslim Ummah, and to reveal the conspiracy of [the] tiny elite who want to enslave the whole of humanity for their evil agendas in the name of a new world order.
এই লেখায় আমেরিকি ইজরায়েলি বাহিনীর ড্রোন হামলা, পাকিস্থানী বাহিনীর নিজেদের ধর্মের মানুষের হাতে নিরীহ মুসলিমদের হত্যা নিয়ে মনস্তাপের সঙ্গী হবেন সবাই। পাশাপাশি সবারই মনে থাকার কথা আফগানিস্থান বা ইরাক যুদ্ধের সময় গোটা বিশ্ব জুড়ে কিরকম প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। সিরিয়া আগ্রাসনের সম্ভাবনাকে কীভাবে গোটা বিশ্ব বাধা দিল। অন্যদিকে এটা কেই বা অস্বীকার করবে সৌদি আরব সহ মুসলিম বিশ্বের বেশীরভাগ রাষ্ট্রনেতাই আমেরিকার অনুচর।
নারী মুক্তি ও সাধারণ গণতান্ত্রিক অবস্থান থেকে কয়েকটি প্রশ্ন রাখা যায় তালিবানি ও অন্যান্য কট্টরপন্থী নেতৃত্বকে, যার প্রতিনিধিত্ব করছে মালালাকে লেখা চিঠির যুক্তিক্রম -
১) নারীর অধিকার আর পুরুষের অধিকার কি মূলগত ভাবেই পৃথক ?
২) শিক্ষার অধিকার সহ বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্নে নারীদের দাবি দাওয়াকে কি রণনৈতিক ও রণকৌশলের অবস্থানের অংশভাগ করে দেখতে হবে ও তেমন হলে রণনৈতিক প্রয়োজনে শিক্ষার অধিকারকে মুলতুবি রাখতে হবে?
৩) তালিবানি ভাবনা অনুযায়ী বুক অব আল্লা বা কোরাণের নিয়ম মতে গোটা দুনিয়াকে চলতে হবে ? অন্তত মুসলিম প্রধান দেশগুলিকে রাষ্ট্র চালনার ক্ষেত্রে কোরাণের নির্দেশিকা, হাদিসের নির্দেশিকা মেনে শরিয়তি আইন মেনে চলতে হবে ? ধর্ম ব্যক্তিগত আচার পালনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করবে ? সবচেয়ে বড় কথা সেই আওতার বাইরে থাকার গণতান্ত্রিক দাবিকে স্বীকার করা হবে নাকি তার জন্য বুলেট বাধ্যতামূলক নিদান ?
৪) কোরাণের শিক্ষা, ইসলামিক শিক্ষা ব্যতীত যে শিক্ষা, সেক্যুলার শিক্ষা তা নাকি শয়তানের শিক্ষা ? শুধুই কোরাণের বা তার অনুমোদিত শিক্ষাই থাকবে বাকি সব কোতল ?
এই প্রশ্নগুলি প্রথমে হয়তো মালালা সরাসরি তোলে নি। কিন্তু মালালা যে অধিকারের জন্য লড়াই করেছে আর গোটা বিশ্বে আলোড়ন ফেলেছে, তার মধ্যেই এই প্রশ্নগুলি নিহিত আছে। মালালার লড়াই থেকে জাত এই প্রশ্নগুলি সেখানকার ও বড় প্রেক্ষাপটে রক্ষণশীল মুসলিম বিশ্বের নারী আন্দোলনের প্রশ্ন যেমন, তেমনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরও প্রশ্ন। এই বিষয়গুলির প্রগতিশীল সমাধানের ওপরই কট্টরপন্থী মুসলিম বিশ্বের নারী আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যৌথ অগ্রগতি সমন্বিত হয়ে আছে।
এবার আসা যাক একেবারে বিপরীত মেরু বলে পরিচিত তথাকথিত মুক্ত সমাজের দেশ আমেরিকার সমাজ রাজনীতির জগতে। বিগত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মহিলা আন্দোলন বা সংলগ্ন বিভিন্ন আন্দোলনের ইস্যুগুলো কীভাবে এসেছে, তার কিছু টুকরো ছবির মধ্য দিয়ে বোঝা যাবে সেখানে নারী ও সংলগ্ন (সমকামী/রূপান্তরকামী/উভকামী) আন্দোলনের বিষয়গুলি কোথায় অবস্থান করছে।
আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও নারী আন্দোলনের ইস্যুগুলো
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থীদের পরাজয়ের পর অনেকেই বেশ স্বস্তির নিস্তার ফেলেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস এর মওরিন দাউদ নির্বাচনের মেজাজকে একেবারে সঠিক ভাবেই ধরে লিখেছিলেন, “রোমনি এবং তার টি পার্টির দলবল অর্ধেক দেশকেই ‘তাদের ধ্রুপদী আমেরিকানা’ র বাইরের লোক বলে বাতিল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা যতই প্রেসিডেন্টকে কটাক্ষ করেছেন, যতই মহিলাদের পরাতে চেয়েছেন সতীত্বকবচ, যতই কালোদের আর সমকামীদের চিন্তাগ্রস্ত করেছেন, ততই এইসব গোষ্ঠীরা আরো দৃঢ়বদ্ধভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছে যে ঐক্যবদ্ধভাবে তারা সাদা মানুষদের আধিপত্যকে শেষ করে দিতে পারে”।
বিশেষ করে মহিলা এবং এল জি বি টি [সমকামী/ উভকামী/ রূপান্তরকামী] আন্দোলনে যুক্ত মানুষদের জন্য নির্বাচনের ফল ঘোষণার রাতটি ছিল নিশ্চিন্তির। সামগ্রিকভাবে নির্বাচনে মেয়েরা পুরুষদের থেকে বেশি ভোট দিয়েছেন। সেনেটে নতুন পাঁচজন মহিলা নির্বাচিত হয়েছেন। মেরিল্যাণ্ড, ওয়াশিংটন এবং মেইনে সমকামী বিবাহকে স্বীকৃতি দিলেও উইসকনসিন থেকে জিতে আসা টাম্মি বলডুইন ছিলেন কংগ্রেসে নির্বাচিত হওয়া প্রথম ঘোষিত পুরুষ সমকামী।
এই নির্বাচনের সবচেয়ে ভালো দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে ধর্ষক দলের পরাজয়। অনেকেই শুনলে আশ্চর্য হবেন যে পৃথিবীর সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলির একটি এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামজিক বিতর্ককে এতটাই দক্ষিণপন্থী জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে মেয়েদের ধর্ষিত না হবার অধিকারের জন্য সেখানে কথা বলতে হয়। অনেক নারী আন্দোলনের কর্মীই খুব খুশি হয়েছিলেন মিশৌরিতে রিপাবলিকান প্রার্থী টড একিন ‘বৈধ ধর্ষণ’ নিয়ে প্রকাশ্যে তার বক্তব্যের পর পরাজিত হওয়ায় বা ইন্ডিয়ানাতে রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড মৌরডক ধর্ষণ জাত গর্ভসঞ্চারকে ঈশ্বরের দান বলে বিতর্কিত হওয়ার সূত্রে সেনেটে তার নিশ্চিত আসনটি হারানোয়।
কিন্তু এরপর কি? প্রথমত রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে একটি ভোট মানেই ডেমোক্র্যাটদের প্রতি প্রশ্নহীন সমর্থন নয়। আমরা যেন গণরায়ের বার্তাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা না করি। বেশিরভাগ মানুষ ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়েছেন মূলত নেতিবাচক জায়গা থেকে, একটি উন্মত্ত রিপাকলিকান কর্মসূচীকে থামানোর জন্য, ডেমোক্র্যাট কর্মসূচী রূপায়ণের জন্য তেমন নয়। আবারো রিচার্ড মৌরডকের উদাহরণটি একটি সূচক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তাকে হারিয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো ডোনেল্লি, মৌরডাকের বিরুদ্ধে জনরায়ের কথা মাথায় রেখেও তার সম্পর্কে একটি কথাই নিরাপদে বলা যায়, ‘তিনি একটি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো’। মহিলাদের পছন্দের অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যিনি খোলাখুলি বলতে পারেন, “আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে আমি সবসময়েই গর্ভপাতের বিরুদ্ধে আর কংগ্রেসেও আমি সেকথাই বলব। জীবনমুখী হওয়া বলতে আমি বুঝি সমস্ত স্তরে জীবনকে রক্ষা করা, সেটা ধারণা জগৎ থেকে স্বাভাবিক মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। জীবনের প্রশ্নে আমি সবসময়েই আমার বিশ্বাস এবং চেতনার জায়গা থেকে ভোট দেব।”
পরিকল্পিত পিতৃ মাতৃত্বর বিরুদ্ধে দুবার ভোট দিয়ে তিনি এই বিষয়ে অর্থসাহায্য আটকে দিয়েছেন। এমন একটি আইনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন যা গর্ভপাতকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় রাখে এমন সুরক্ষা বিমা গ্রহণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে। কৃচ্ছাসাধন নীতির কট্টর প্রবক্তা হিসেবে তিনি ব্যবসার জন্য করছাড়ের পক্ষে ওকালতি করেন এবং যুদ্ধবাজ হিসেবে রিপাকলিকানদের পক্ষভূক্ত হয়ে আফগানিস্থান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে ভোট দেন।
মৌরডাকের বিরুদ্ধে ভোট মানে কি তাহলে ডোনেল্লির রাজনৈতিক দিশাকে সমর্থন করা ? নিশ্চিতভাবেই না। প্রজনন অধিকারের বিষয়টিই ধরা যাক। গুটমাচের ইনস্টিটিউট এর তথ্য অনুসারে ২০০৬ সালে ইন্ডিয়ানার গর্ভসঞ্চারের ৪৮ শতাংশই ছিল অপরিকল্পিত। কিন্তু প্রজনন অধিকারের ওপর দুই দলেরই আক্রমণের ফলে ইন্ডিয়ানার পঁচানব্বই শতাংশ এলাকাতেই গর্ভপাতের কোনও ব্যবস্থা নেই। এখানে পরিকল্পিত মাতৃত্বকেন্দ্রগুলিতে গরীব মহিলারা ভীড় জমান। প্রতি বছর ৯০০০ এরও বেশি মহিলা এই পরিষেবার ওপর নির্ভর করে থাকেন।
ইন্ডিয়ানার ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় যেখানেই জনগণ সুযোগ পেয়েছে সেখানেই তারা বিভিন্ন ইস্যুতে খোলাখুলিভাবে প্রগতিশীল বক্তব্য রাখা প্রার্থীদের ভোট দিয়েছে। গেল্ডা রিজ নামের একজন সরকারী স্কুল শিক্ষক এবং সংগঠন কর্মী, রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয় কর্মাধ্যক্ষর আসনে বিগত বার নির্বাচিত হওয়া রিপাকলিকান প্রার্থী  টনি বেনেটের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। নির্বাচকরা রিজকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছে। তিনি পেয়েছেন প্রায় তের লক্ষ ভোট যা রিপাকলিকান প্রার্থীর থেকে প্রায় এক লক্ষ বেশি। অন্যভাবে বলা যায় বাজেট ব্যয় বরাদ্দ হ্রাসের বিরুদ্ধে এবং শিক্ষায় সরকারী ব্যয় বরাদ্দ ও সংগঠন করার অধিকারের পক্ষে বেশির ভাগ মানুষ ভোট দিয়েছেন।
আবার এই নির্বাচনই আমেরিকার ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যায়বহুল নির্বাচন, যার খরচ ছ’শ কোটি ডলার ছুঁয়েছে। এটা এমন একটা দেশ যেখানে ৮১ শতাংশ আমেরিকানই বিশ্বাস করেন, “কর্পোরেটদের রাজনৈতিক খরচের সামনে সাধারণ মানুষের কথা হারিয়ে যায় আর কর্পোরেট সি ই ও দের রাজনৈতিক প্রভাব অত্যধিক’। এই বিশাল মূল্যের নির্বাচনের থেকে আমরা কি ‘আশা’ বা ‘পরিবর্তন’ই বা পেতে পারি?
নির্বাচনের সময় থেকেই ওবামা বলছেন তাঁর দ্বিতীয় দফায় তিনি সমকামী বিবাহ নিয়ে লড়াই করবেন না। দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই তিনি ইয়েমেন এ ড্রোন বিমান [চালকহীন স্বয়ংক্রিয় বিমান] পাঠান। রাজকোষ ঘাটতি সংক্রান্ত তার কথাবার্তা থেকে মনেই হচ্ছে এটা নানা সামাজিক সুরক্ষার বিরুদ্ধে একটা প্রকাশ্য যুদ্ধের পূর্বাভাষ। ডেমোক্র্যাটরা তাদের এই বিজয় সাফল্যের সুযোগে সামাজিক ব্যয়ের জন্য ধার্য লক্ষ লক্ষ ডলার কাটছাঁট করতে আগ্রহী। রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার রায়ান গ্রিন এবং সারা বাফকিন সঠিকভাবেই বলেছেন, “ আর্থিক সিঁড়িতে সম্পদকে ওপরের দিকে পাঠানোর বিষয়টি ওয়াশিংটনে ‘মহা দরাদরি’ নামেই পরিচিত”। ওবামার সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বলা যায় তিনি ইজরায়েলকে গাজায় ধ্বংসলীলা চালিয়ে তাকে মৃত্যু উপত্যকা বানানোয় পরিপূর্ণ ছাড়পত্র দিয়েছেন। ওবামার ছাড়পত্র হাতে নিয়েই ইজরায়েল শিশুসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষকে বোমা বর্ষণ করে হত্যা করে চলেছে।
নারী ও সংলগ্ন বিভিন্ন অধিকার আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে দেখলে বলাই যায় আপাত নির্বাচনী পছন্দের মধ্যে নিহিত প্রকৃত পছন্দহীনতার দিকটি এর আগে কখোনোই এতটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির জন্য মানুষ চার বছরের জন্য ভোট দেয় নি। মানুষ ভোট দিয়েছে পাগলাটে কর্মসূচী ও ধর্ষকামী ব্যক্তিবর্গকে আটকানোর জন্য, লিঙ্গসাম্যের জন্য, আরো ভালো অবসরকালীন সুযোগ সুবিধার জন্য, আরো সুবিধাজনক স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য। এই নির্বাচন থেকে কি বেরিয়ে আসছে সেদিকে নজর দিলে দেখা যাবে হিসাবের খতিয়ানটা মোটামুটি পরিস্কার। ভোটাররা দ্বিধাহীনভাবে ধর্ষকামীদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। ম্যাসাচুসেটস এবং ইন্ডিয়ানার টি ব্যাগারদের ছুঁড়ে ফেলার কথা বলেছেন। কিন্তু একমাত্র স্বাস্থ্যবীমা ছাড়া বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার একটার রপায়ণেও ওবামা যত্নবান নন। নারী আন্দোলন বা এল জি বি টি আন্দোলন (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার) এর দাবিগুলি পালনে যেমন তার অনীহা রয়েছে, তেমনি সামাজিক সুরক্ষাকবচ গুলির রক্ষা, ড্রোন হামলায় মানুষ না মারা, নাগরিক অধিকার রক্ষা করার মত কোন বিষয়েই কোন প্রতিশ্রুতিই তিনি দেন নি। নারী আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন এর সামনে পরিস্কার হয়ে গেছে, মুক্তির জন্য অনেকটা পথ পেরোতে হবে। ধারাবাহিক লড়াই জারী রাখতে হবে।
এবার আমরা চলে আসবো ভারতের নারী আন্দোলনের কয়েকটি প্রসঙ্গের দিকে। শুরু করা যাক দিল্লিতে নির্ভয়ার ধর্ষণ, তার মৃত্যু, গোটা দেশে এর প্রতিক্রিয়া ও নারী আন্দোলনের এক নতুন পর্যায়ের জন্মের ঘটনাটির মধ্য দিয়ে।
ভারতের একটি সাড়া জাগানো ঘটনা : দিল্লি ধর্ষণ ও কোলকাতার প্রতিক্রিয়া
২৭ ডিসেম্বর, ২০১১ মধ্যরাতে এলো সেই মর্মান্তিক খবর। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে মারা গেছেন সেই তরুণী, যাকে নির্ভয়া বলে চিনেছিল গোটা দেশ। নির্যাতনকারী ও তাদের দেওয়া প্রাণান্তক আঘাতের সঙ্গে অসম্ভব সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে শেষপর্যন্ত লড়াই চালিয়েও তাকে চলে যেতে হল। সে চলে গেল, কিন্তু রেখে গেল অজস্র প্রশ্ন আর বেআব্রু করে দিল আমাদের সমাজের পিতৃতান্ত্রিক দমনের যাবতীয় চিহ্নগুলিকে, আমাদের সরকার, পুলিশ প্রশাসন, আইন বিচার ব্যবস্থা সহ যাবতীয় ‘গণতান্ত্রিক’ কাঠামোর চরিত্রকে। তার চলে যাওয়ার শোক থেকে দ্রুতই উঠে এল শপথ। সে শপথ নিয়ে পরদিন সারা দেশ নতুন করে রাস্তায় নামল, কোলকাতাও উত্তাল হল প্রতিবাদে। ছাত্র যুব মহিলাদের সঙ্গে শহরের আরো অনেক গণতান্ত্রিক মানুষ পা মেলালেন শোক আর শপথে মেশা এক দৃপ্ত মিছিলে। কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল এগিয়ে চলল এসপ্ল্যানেড মেট্রো চ্যানেল এর দিকে। মিছিল ও পথচলা শেষের সংক্ষিপ্ত সভায় মৃতা তরুণীর মৃত্যুতে ব্যক্ত হল গভীর শোক, সমবেদনা জানানো হল তার পরিবার পরিজনকে। মিছিল থেকে আসা শপথের দৃঢ় স্বর জানালো আগামী দিনগুলোয় সমস্ত ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি হিংসা ও নারী পুরুষ পৃথগীকরণকে প্রতিরোধ করতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে বাড়িতে, রাস্তায়, সামাজিক ক্ষেত্রে, সমস্ত প্রতিষ্ঠানে। নারী পুরুষ পৃথগীকরণ ও নারীর প্রতি হিংসাকে তিল পরিমাণেও সহ্য করতে রাজী নই আর কেউ। আমাদের সমাজ থেকে পিতৃতান্ত্রিক সমস্ত দমনকে উচ্ছেদ করতেই হবে। আর এই লক্ষ্যেই আমাদের দেশের রাজ্যের সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রশ্নে বিদ্ধ করল শোক আর সংকল্পে আপ্লুত ছাত্র যুব মহিলারা। প্রশ্ন উঠল আমাদের রাজ্যের ধর্ষণের ঘটনাগুলিকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে কেন? কেন পার্কস্ট্রিটের ধর্ষিতা মহিলা এখনো বিচার পেলেন না ? মুখ্যমন্ত্রী, তার মন্ত্রীসভা ও দলের সতীর্থ সতীর্থারা নির্যাতিতা মহিলাদের ন্যায় বিচার দেওয়ার পরিবর্তে কেন তাদেরই চরিত্র নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলছেন? এমনকী বিচারাধীন বিষয়েও কেন ‘রায়’ দিয়ে বসছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ? মিছিল থেকে ধীক্কার দেওয়া হয় দিল্লি আর পার্কস্ট্রিটকে আলাদা করতে চাওয়া তৃণমূল ঘনিষ্ঠা এক নাট্যকর্মীকে, পার্কস্ট্রিটের নির্যাতনের ঘটনাটিকে মহিলা ও তার খরিদ্দারের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বলে মহিলার চরিত্রে কলঙ্কলেপন ও বিচারকে প্রভাবিত করার চেষ্টাকারী তৃণমূল সাংসদকে। ধীক্কার দেওয়া হয় মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যকারী আনিসুর রহমান ও দিল্লি তথা সারা দেশের বিক্ষোভকারীদের ‘ডেন্টেট পেইন্টেড’ বলে অবমাননাকারী কংগ্রেস সাংসদ ও রাষ্ট্রপতি তনয় অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়কেও।
৩১ তারিখ, বছরের শেষ দিনে ছাত্র যুব মহিলারা গানে ছবিতে পোষ্টারে মোমবাতির আলোয় শোক ও শপথের বার্তাকে ছড়িয়ে দিতে ও রাজ্যের সর্বত্র ঘটে চলা মহিলাদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে সরকার ও প্রশাসন এর নিস্পৃহতা, ঘটনাকে আড়াল করতে চেয়ে পক্ষপাতমূলক বক্তব্য, বিশেষ করে পার্কস্ট্রিটের ঘটনায় শাসক দলের নেতা নেতৃদের নক্কারজনক মন্তব্যের প্রতিবাদে অবস্থান করেন পার্কস্ট্রিট চত্বরেই। বহু সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই অবস্থানে যোগ দেন, বক্তব্য রাখেন। তুলে নেন পোষ্টার, জ্বালিয়ে রাখেন মোমবাতির শিখা। কোলকাতার প্রতিবাদের এই ছবিটি দেখা গিয়েছে দেশের সর্বত্র, এমনকী আন্দোলনে খানিক নির্লিপ্ত মুম্বাইও দেখল প্রতিবাদের আশ্চর্য বর্ণময়তা।
এরপর কোলকাতার অদূরে বারাসাতের কামদুনিতে এক ছাত্রীর একই রকম মর্মান্তিক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটে যায় কোলকাতায়, আর তা নিয়ে উত্তাল হয় রাজ্য। কোলকাতার রাজপথ শাসকের সমস্ত রকম রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দেখে এক ঐতিহাসিক মিছিল। কামদুনির আন্দোলনকে দমন করার সমস্ত রকম কৌশলের পাশাপাশি রাজ্য এবং দেশের নানাপ্রান্ত থেকে অবিরত আসতে থাকে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা সমূহ। মুম্বাইতে এক চিত্র সাংবাদিকের ধর্ষণও আলোড়ন তোলে মিডিয়াতে।
একদিকে যখন নারী আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন এই সমস্তর শেষ দেখতে চেয়ে  নারীদের নির্ভয় স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার, ভার্মা কমিশন মহিলাদের ওপর নিপীড়ণ রোধে সরকারকে কিছু বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেবার পরামর্শ পাঠাচ্ছে, গণ আন্দোলনের চাপে তার কিছু কিছু নিয়ে নতুন আইন পাশ করতে হচ্ছে সরকারকে, তখন বিপরীতে পুরুষতন্ত্র তাকে নানাভাবে প্রত্যাঘাত করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আধুনিক ভারতের সমস্ত বিজ্ঞাপণকে ব্যঙ্গ করে দেখা যাচ্ছে খাপ পঞ্চায়েতগুলির দৌরাত্ম, অনার কিলিং এর নামে পিতৃতন্ত্রকে বজায় রাখার জন্য হত্যালীলা, যার বলি শুধু তরুণ তরুনীদের প্রাণই নয়, তাদের স্বাধীনভাবে নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নেবার অধিকারও। অন্যদিকে নারীদের সুরক্ষার নামে, তাদের পাশে থাকার ভেক ধরে নারীকেই পোষাক ব্যবহার থেকে জীবনাচরণের নানা ক্ষেত্রে বেড়ি পেরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে পুরুষতন্ত্র। এমনকি তথাকথিত প্রগতিশীল শিবিরের কৃষক ও কমিউনিস্ট নেতাকেও আমরা দেখছি খোলা মঞ্চ থেকে নারী সমাবেশেই এমন নিদান দিতে। জামাত এ ইসলামি হিন্দের ডাকে 'নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার অভিযান' শীর্ষক এক জনসভায় যোগ দিয়ে সি পি এমের রাজ্য কমিটির সদস্য, তথা কৃষক সভার গুরূত্বপূর্ণ নেতা, দীর্ঘদিনের বিধায়ক রেজ্জাক মোল্লা সাহেব মন্তব্য করেছেন, "এখন যারা প্যান্ট-গেঞ্জি-টপ পরছে তারা গোল্লায় যাক। আপনারা সালোয়ারের উপরে উঠবেন না”। “আমরা বাড়ির দুই মেয়ের একজন ডবলিউবিসিএস এবং একজন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার৷ তাদের দু'জনকে সালোয়ার-কামিজের মধ্যে ধরে রেখেছি৷”
সাম্প্রতিক এই মন্তব্য নিয়ে কয়েকটি কথা সরাসরি বলা যায় রেজ্জাকবাবু বা যারা নারীর নিরাপত্তার জন্য তাকেই ঘেরাটোপে পড়ার নিদান দিচ্ছেন তাদেরকে
১) আপনার বাড়ির মেয়েদের আপনারা নিয়ন্ত্রণ করেন কেন? তারা তো প্রাপ্তবয়স্ক। [উচ্চশিক্ষিত কথাটা এখানে বলার নয়, তার কারণ অল্পশিক্ষিত হলেও তাকে নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা থাকা উচিৎ নয়।]
২) প্যান্ট গেঞ্জি টপ কুরুচি সম্পন্ন পোষাক এটা আপনাদের কে বলল?
৩) কুরুচি সম্পন্ন পোষাক নারী নিগ্রহের কারণ - কটা নিগ্রহের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে আপনাদের এমত মনে হয়েছে ?
রেজ্জাকবাবুর মত অনেকেই আসলে নারীদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার নামে বলতে এসে আসলে তাদের মর্যাদা ও অধিকারকেই খর্ব,নিয়ন্ত্রিত করে ফেলছেন। নারীদের নির্ভয় স্বাধীনতার জন্য চলমান আন্দোলনের বিপ্রতীপ স্রোত পুরুষতন্ত্রকেই এসমস্ত মন্তব্যে জোরদার করা হয়। কিছুদিন আগে তৃণমূলের বিধায়ক ও অভিনেতা চিরঞ্জিৎকে আমরা এ ধরণের মন্তব্য করতে শুনেছি। আসলে পুরুষতন্ত্র এমনকী  ধর্ষণের যাবতীয় দায়ও মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়ে পোষাক ফতোয়া ও অন্যান্য আচরণবিধি জারী করে। আক্রান্ত মহিলার চরিত্র চালচলন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চায়। ধর্ষণের ঘটনাগুলিকে জুজু হিসেবে সামনে রেখে পিতৃতান্ত্রিক বিধি বিধানকে আরো জোরদার করতে চায়। ধর্ষণের সংস্কৃতিকে পালটানো পুরুষতন্ত্রের সামগ্রিক আগ্রাসনকে পালটানোর বৃহৎ লড়াইয়ের বাইরের কোনও ব্যাপার নয়। ধর্ষণ শারীরিক লালসার পরেও নারীর ওপর আধিপত্য কায়েমের একটা মনোভাব, যার চিহ্ন পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ‘বিতত বিতংসে’র মতো ছড়িয়ে আছে।
নির্ভয়াদের শারীরিক মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু মৃত্যুর পরেও তাদের অপরাজেয় কন্ঠস্বর ধ্বনিত হচ্ছে পিতৃতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে নারীমুক্তির প্রশ্নে এগিয়ে চলা নাছোড় লড়াইয়ের ময়দানে। দিল্লি থেকে গোটা দেশজুড়ে নারী আন্দোলনের একের পর এক ঢেউ, তাদের নির্ভয় স্বাধীনতার দাবি বর্তমান ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভ। একথা স্পষ্ট শুধু নারীমুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, গণতন্ত্রকে মজবুত করা ও সম্প্রসারিত করার প্রেক্ষিত থেকেো নারী আন্দোলন গোটা দুনিয়া জুড়েই অসীম গুরূত্বে অবস্থান করছে।

No comments: