সাম্রাজ্যবাদ বদলে যেতে থাকা সময়ে নতুন নতুন
ক্ষেত্রে,নতুন নতুন অস্ত্রে শান দিয়ে তার আগ্রাসন
চালিয়ে যেতে সচেষ্ট। আজকের পৃথিবী সাম্রাজ্যবাদ বলতে নানা কারণে মূলত মার্কিন
সাম্রাজ্যবাদকেই বুঝে থাকে। তার আগ্রাসনের নানা ধরণের মধ্যে একটি নতুন দিক খুব
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। জানা গেছে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদ (এন এস এ)
পৃথিবীব্যাপী ইন্টারনেট পরিষেবা থেকে
প্রতি ঘন্টায় কুড়ি লক্ষ গিগাবাইট (জিবি) তথ্য সংগ্রহ করছে এবং এই অতি বিপুল পরিমাণ
তথ্য দুশো কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত তথ্যখনিতে সঞ্চিত রাখছে। এই গোপন প্রকল্পটির
নাম দেওয়া হয়েছে প্রিজম প্রকল্প। ২০০৭ সাল থেকে এই প্রকল্পটি চালু রয়েছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পরিচালিত এই নয়া প্রকল্পের
খুঁটিনাটি প্রকাশ করে দিয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদেই কর্মরত এক বিশেষজ্ঞ,এডওয়ার্ড স্নোডেন। স্নোডেন এই খবর প্রকাশিত হবার
আগেই আমেরিকা ত্যাগ করেন এবং বর্তমানে তিনি এই ঘটনার সূত্রে আমেরিকার জারি করা
গ্রেপ্তারী পরোয়ানা এড়াতে হংকং হয়ে রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন।
গার্ডিয়ান ও ওয়াশিংটন পোষ্ট পত্রিকাতে ৫ জুন, ২০১৩ প্রথম প্রকাশিত হয় স্নোডেন এর ফাঁস করে
দেওয়া চাঞ্চল্যকর তথ্য এবং তার পর থেকেই এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে বিপুল আলোড়ন।
সেই আলোড়নের ইতিবৃত্ত ও তার তাৎপর্যে যাওয়ার আগে দেখে নেওয়া যাক গার্ডিয়ান ও
অন্যান্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই নজরদারির বিভিন্ন দিক।
আমেরিকা ইন্টারনেটের জন্মদাতা ও সেইসূত্রে
বিশ্বজোড়া ইন্টারনেট চলাচলের পথের জাংশন হিসেবে তার অবস্থান। তার স্থলভাগের মধ্য
দিয়ে প্রবাহিত ইন্টারনেট পথ থেকেই শুধু নয়, লাতিন
আমেরিকা, উত্তর আফ্রিকার উপকুল অঞ্চল এবং ভারত
মহাসাগরের তলা দিয়ে প্রবাহিত ইন্টারনেট কেবল থেকেও এন এস এ বিরাট পরিমাণ তথ্য
সংগ্রহ করে নিচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিশ্বের প্রধান ইন্টারনেট দৈত্যকায়
সংস্থাগুলির প্রায় সবকটিই আমেরিকান, যার মধ্যে আছে গুগুল,মাইক্রোসফট,ফেসবুক,ইয়াহু,ইউ টিউব,স্কাইপ,অ্যাপেল প্রভৃতি। এই সমস্ত সংস্থার কাছ থেকে
আমেরিকান সরকার বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করছে,কোথাও
তাদের স্বেচ্ছা সম্মতিতে, কোথাও সরকারী ক্ষমতার বলে। স্নোডেন এর
ফাঁস করা তথ্যাবলী থেকে জানা গেছে এন এস এর পাশাপাশি ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা জি সি
এইচ কিউ ও একইভাবে ইন্টারনেট ও টেলিফোন পরিষেবার ওপর মার্কিন মদতে নজরদারি চালাচ্ছে।
জানা গেছে এন এস এ এই কাজে জি সি এইচ কিউ কে প্রযুক্তিগত সাহায্যের পাশাপাশি ১০
কোটি পাউণ্ড অর্থ সাহায্যও করেছে।
প্রিজম প্রকল্পর কথা প্রকাশ্যে আসার পর আমেরিকা ভেতরে
ও বিশ্ব জুড়ে প্রবল আলোড়ন উঠেছে। ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশিত হয়ে যাবার আশঙ্কায়
নাগরিকরা আতঙ্কিত। কথা উঠেছে এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে,যা আইন বিরোধী। মার্কিন নাগরিকদের দেশজোড়া
প্রতিবাদের পর তাদের আশ্বস্ত করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা জানিয়েছেন,কেবলমাত্র বিদেশীদের তথ্যই সংগ্রহ করা হচ্ছে,আমেরিকার নাগরিকদের নয়,আর
এই প্রকল্প তাই আমেরিকার আইনের বিরোধী নয়। সেইসঙ্গে মার্কিন কর্তৃপক্ষ ৯/১১
পরবর্তী সন্ত্রাস হানার জুজুকে ব্যবহার করে জানিয়েছে এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে জঙ্গী
হানা রোখা সম্ভব হচ্ছে। তাদের দাবি অনুযায়ী ইতোমধ্যে তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে আগাম
ব্যবস্থা নিয়ে ৫০ টি জঙ্গী হানাকে রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে,যার
১০ টি পরিকল্পিত ছিল আমেরিকার মাটিতে। কিন্তু এই সব যুক্তিজাল ব্যবহার করেও ব্যাপক
গণক্ষোভকে সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
কারণ বিভিন্ন সংবাদপত্রের তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট
থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে জঙ্গী হানার প্রসঙ্গ তোলা হচ্ছে জনগণের সহানুভূতি অর্জন
এবং প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার জন্য। এন এস এ কি ধরণের তথ্যাবলী সংগ্রহ করেছে, বা
তাদের কী ধরণের কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেটা বিশ্লেষণ করলেই এটা স্পষ্ট হয়ে
যাবে যে জঙ্গী হানা রোখার আছিলায় আসলে সারা বিশ্বের ওপর নজরদারি চালিয়ে, অন্য
দেশগুলির পরিকল্পনা ও তথ্য জানার মাধ্যমে কূটনৈতিক থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক
কর্তৃত্ব বজায় রাখাই এই প্রকল্পের প্রকৃত লক্ষ্য। আর এটা স্পষ্ট হয় ফাঁস হওয়া তথ্যাবলীর
সূত্রে প্রাপ্ত গোপন মার্কিন গোয়েন্দা কার্যক্রমের বিশ্লেষণ থেকেই।
এপ্রিল ২০১৩ তে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন
হোয়াইট হাউসে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। আলোচনার
তালিকায় ছিল সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার, ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে
শান্তি সংক্রান্ত কথাবার্তা এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের মত বিষয়গুলি। এই আলোচনা হওয়ার
কথা এক উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে। এন এস এ আগেভাগেই বান কি মুন কি বলতে পারেন সে
বিষয়ে জানার জন্য নানা নজরদারি চালায়। এটা বুঝে ওঠা খুবই বিষ্ময়কর এখানে জঙ্গী
হানা রোখার সম্পর্ক কোথায়। আসলে আগেভাগে এইসব তথ্য জানলে ওবামা কথোপকথনে কিছু
বাড়তি লাভ পাবেন, এরকম ভাবনা থেকেই এই নজরদারী।
এন এস এ কি ধরণের নজরদারী বা হানাদারি চালাবে তা
নিয়ে এমনকী স্বয়ং প্রেসিডেন্ট এর থেকে নির্দেশিকা এসেছে। স্নোডেন এর তুলে দেওয়া
তথ্যর ভিত্তিতে ৭ জুন প্রকাশিত এক রিপোর্টে গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে ওবামা
নিজেই জাতীয় বরিষ্ঠ নিরাপত্তা প্রধানদের নির্দেশ দিয়েছিলেন আমেরিকার সুবিধার্থে
কোন কোন দেশের ওপর সাইবার আক্রমণ চালানোর প্রয়োজন, তার তালিকা তৈরি করতে। ২০১২
সালের অক্টোবর মাসে এই নির্দেশিকাটি তৈরি হয়েছিল, যদিও তা কোনদিনই এর আগে
প্রকাশ্যে আসে নি। ১৮ পাতার এই নির্দেশিকায় এই কার্যক্রমকে বলা হয়েছে ‘অফেনসিভ
সাইবার এফেক্ট অপারেশন’ (ওসিইও)। এই আগ্রাসী সাইবার কার্যকলাপ এর লক্ষ্য
‘বিশ্বব্যাপী নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যের ওপর সাইবার হানায় এমনভাবে ক্ষমতাসীন হয়ে
ওঠা, যাতে লক্ষ্যবস্তু কোনও সংকেত পাবার আগেই তার ওপর মারাত্মক আঘাত হানা যায় বা
এমন সূক্ষ্মভাবে আঘাত করা যায় যাতে সে আঘাতের বিষয়টি বুঝেই উঠতে না পারে’। ওবামার
নির্দেশিকা বিশ্বজোড়া সাইবার যুদ্ধের সম্ভাবনাকে অনেক তীব্র করে তুলেছে। ‘ও সি ই
ও’ সংক্রান্ত তথ্যাবলী প্রকাশ্যে আসার আগেই চিনা কর্তৃপক্ষর তরফে জানানো হয়েছিল
চিনের বিভিন্ন সাইবার কর্মকাণ্ডের ওপর আমেরিকার হানাদারী বিষয়ে হাজারো তথ্যপ্রমাণ
তাদের কাছে আছে। ইরান দাবি করেছে তাদের ইউরেনিয়াম গবেষণা প্রকল্পের ওপর আমেরিকা
সাইবার হানা চালিয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাইবার জগতের ওপর নজরাদারি
ও তাকে ক্ষতিগ্রস্থ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন
রাষ্ট্রপ্রধানদের কথাবার্তার ওপর এন এস এ ধারাবাহিক নজরদারি চালিয়ে এসেছে এবং এ
বিষয়ে কোনও ‘শত্রু মিত্র’ র বাদবিচার করা হয় নি। ফ্রান্স বা জার্মানির ক্ষেত্রে
কূটনৈতিক সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে যেমন নজরদারি চালানো হয়েছে, তেমনি আর্থিক নীতির
অন্দর মহলের খবর জানতে নজরদারি চলেছে ব্রাজিল বা জাপানের ওপর।
আমেরিকার পাশাপাশি তাদের সহায়তায় ব্রিটেনও এই কাজ
করেছে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা জি সি এইচ কিউ এর মাধ্যমে। ২০০৯ এর সেপ্টেম্বরে
লন্ডনে আয়োজিত হয় জি-২০ সম্মেলন। এই সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের কথাবার্তার ওপর,
যারা সকলেই নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও
কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এন এস এ র সহায়তায় জি সে এইচ কিউ বহুমাত্রিক নজরদারি চালায়।
যে ইন্টারনেট ক্যাফেগুলি আগত রাষ্ট্রপ্রধানদের ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য খোলা
হয়েছিল, সেখানে ই মেইল নজরদারির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল। আগত
প্রতিনিধিদের ব্যবহৃত ব্ল্যাকবেরী ফোন এর ই মেইল ও কথাবার্তার ওপরও চালানো হয়েছিল
নজরদারি। সামিট চলাকালীন কে কাকে ফোন করছেন শুধু তা জানার জন্যই নিযুক্ত করা
হয়েছিল ৪৫ জন বিশেষজ্ঞকে।
লন্ডনে জি-২০ সামিট এর ওপর নজরদারির তথ্য
প্রকাশের পর তুমুল আলোড়নের আবহাওয়ার মধ্যেই ৩০ জুন, ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত এক
রিপোর্টে গার্ডিয়ান পত্রিকা জানায় নিউ ইয়র্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিশনের ওপর এবং ওয়াশিংটনে
অবস্থিত এর দূতাবাসের ওপর এন এস এ-র নিয়মিত নজরদারির কথা। স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্য
উদ্ধৃত করে এই রিপোর্ট জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর মিশন ও দূতাবাস ছাড়াও বিভিন্ন
দেশের আরো আটত্রিশটি মিশন বা দূতাবাসের ওপর এন এস এ নজরদারি চালিয়েছে। এই তালিকায়
ফ্রান্স, ইতালি, গ্রীস, জাপান, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া, তুর্কি ছাড়াও রয়েছে ভারত।
বিভিন্ন কূটনৈতিক বিষয়ে অন্যান্যদের অবস্থান জানার জন্যই যে আমেরিকার এই চোরাগোপ্তা
সাইবার হানা, তা অত্যন্ত স্পষ্ট।
গার্ডিয়ান পত্রিকা তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে এই
তথ্যের একাংশ আমেরিকান কর্তৃপক্ষ ব্রিটেন,ইজরায়েলের
মতো তার মিত্র দেশদের সঙ্গেও ভাগ করে নিচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এই
প্রকল্পের খবরে ব্যাপক দুশ্চিন্তা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এই নজরদারির বিরুদ্ধে
ব্রাজিলের বাম ঝোঁক সম্পন্ন সরকারের রাষ্ট্রপতি দিলমা প্রথম তীব্র প্রতিবাদ জানান।
অতঃপর শত্রু মিত্র নির্বিশেষে প্রতিবাদ আসতে থাকে আমেরিকার সাইবার হানাদারি নিয়ে।
তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানী এবং স্পেন। ইউরোপীয়
ইউনিয়নের ন্যায় বিষয়ক কমিশনার ভিভিয়ানে রিডিং আমেরিকার অ্যাটার্নি জেনারেলকে চিঠি
লিখে এই প্রকল্পের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন। জার্মানি,ইতালি, ফ্রান্স এর
মতো দেশগুলি এ ব্যাপারে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে চিন,রাশিয়ার কাছ থেকেও। তবে এই সমস্ত দেশগুলি নিজেদের
নাগরিকদের থেকেও গোপনে এই ধরণের তথ্য সংগ্রহ অভিযান চালাচ্ছে কিনা,তা নিয়ে কোনও কোনও মহল থেকে সন্দেহ প্রকাশ করা
হয়েছে।
সাইবার জগতে মার্কিন ও ব্রিটিশের নজরদারির ঘটনায়
বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষের মতোই কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে লেখক
বুদ্ধিজীবী মহল থেকেও। মার্গারেট অ্যাটয়ুড, ওরান পামুক, গুন্টার গ্রাস, অরুন্ধুতী
রায় সহ গোটা বিশ্বের একাশিটি দেশের পাঁচশোরও বেশি বিশিষ্ট লেখক বুদ্ধিজীবী, যাদের
অনেকেই নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত, এক যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে গণতান্ত্রিক
অধিকারের ওপর এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ও অন্যান্য শক্তিশালী
দেশগুলি যখন এন এস এ-র প্রিজম এর মতো হানাদারি প্রকল্পে তাদের নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনিয়তা ও
রাষ্ট্রনায়ক তথা রাষ্ট্রের গোপন তথ্যাবলীর ওপর হানাদারির বিষয়টি নিয়ে তীব্র
প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তখন সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি আক্রান্ত
হচ্ছে দেখেও ভারত সরকার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানিয়ে উঠতে পারে নি। অথচ ভারতের ওপরেও কি
ধরণের নজরদারি চলেছে, তা এই পর্বে বিভিন্ন রিপোর্টেই প্রকাশিত হয়েছে। স্নোডেন এর
ফাঁস করা দলিল থেকে পাওয়া গোপন নথির ভিত্তিতে প্রস্তুত কয়েকটি রিপোর্ট ২৪ ও ২৫
সেপ্টেম্বর ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ এবং ২৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায়
প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্ট অনুসারে ওয়াশিংটনে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস ও নিউ ইয়র্ক এর
জাতিসঙ্ঘের ভারতীয় মিশনের কম্পিউটার এর ওপর গোপন নজরদারি চালিয়ে তা থেকে প্রভূত
পরিমাণ গোপন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সাধারণ নাগরিকদের পাঠানো ই মেল, এস এম এস বা
ফোন কল এর মত বিষয়েই কেবল নজরদারি চালানো হয়নি, জানার চেষ্টা করা হয়েছে রাষ্ট্রের
গোপন গুরূত্বপূর্ণ তথ্যাবলী। আর্থিক, রাজনৈতিক নীতিমালা ছাড়াও মহাকাশ গবেষণা ও তার
প্রযুক্তি, নিউক্লিয় গবেষণা ও তার প্রযুক্তি সহ প্রতিরক্ষা বিষয়ক গোপন তথ্য সংগ্রহ
করাই যে এই নজরদারির মূল লক্ষ্য ছিল, তার নিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে আর স্বাভাবিকভাবেই
তা জঙ্গীহানা রোখার জন্য এই প্রকল্প চালানোর দাবিকে হাস্যকর মিথ্যায় পর্যবসিত করেছে।
এন এস এর নজরদারি বিষয়ে তথ্য যখন সামনে আসতে শুরু
করেছে সে সময় মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব জন কেরী তার ভারত সফর পর্বে গোটা নজরদারির
বিষয়টিকে লঘু করে দেখিয়ে বলতে চেয়েছিলেন জঙ্গী হানা রোখা ছাড়া এই নজরদারির অন্য
কোনও লক্ষ্য নেই। ভারতের পক্ষ থেকে সে সময়ে কোনও কড়া প্রতিবাদ জানানো হয় নি, বরং
ভারতের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী কপিল সিব্বাল আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট জন
কেরীর কথার প্রতিধ্বনি করে বোঝাতে চেয়েছিলেন জঙ্গী হানার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহই এই
নজরদারির লক্ষ্য এবং নাগরিকদের ব্যক্তিগত ই মেল, ফোন কল প্রভৃতি সুরক্ষিত ও গোপন।
কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক, আর্থিক নীতিমালার পাশাপাশি মহাকাশ ও নিউক্লিয় গবেষণা সহ
সামরিক ক্ষেত্রের ওপর নজরদারি সংক্রান্ত গোপন ফাইলগুলি প্রকাশিত হবার পর আমেরিকার
পাশাপাশি ভারতের বশংবদ চাটুকার শাসক শ্রেণিও বেয়াব্রু হয়ে পড়েছে।
ভারত মার্কিন বন্ধুত্বের আসল চেহারাটি ক্রমশই
সামনে আসছে এবং তা নতজানু ভারতের শাসক শ্রেণির মেরুদণ্ডহীনতা ও বশংবদ মনোভাবকে
ক্রমেই প্রকাশ করে দিচ্ছে। বাহ্যত দৃশ্যমান পারস্পরিক সৌহার্দের ছবির আড়ালে
আমেরিকার আগ্রাসী মনোভাব ও তার বিপ্রতীপে ভারতের শাসক শ্রেণির দাসসুলভ মনোবৃত্তির চেহারাটি
এর আগেও বিভিন্ন গোপন রিপোর্ট সামনে আসার মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়েছিল। জুলিয়ান
অ্যাসাঞ্জ এর উইকিলিকস কেবল বার্তা থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম ভারত মার্কিন পরমাণু
চুক্তি নিয়ে প্রথম ইউ পি এ সরকার যখন আস্থাভোটের মুখোমুখি, তখন কংগ্রেস নেতারা
আমেরিকান কূটনীতিকদের ট্রাঙ্ক ভর্তি টাকা দেখিয়ে আস্বস্ত করতে চেয়েছিলেন, ‘আস্থা
ভোটে জিতে পরমাণু চুক্তি করার পথ পরিস্কার হয়ে গেছে’। কেন কংগ্রেস নেতারা আমেরিকান
কূটনীতিকদের বলতে গেলেন আস্থাভোটে জয়ের জন্য ভোট কেনার পরিকল্পনার কথা, আর কেনই বা
তাদের ট্রাঙ্ক ভর্তি টাকা দেখালেন? এর স্পষ্ট কারণ একটাই। তাদের আমেরিকি প্রভুদের
এটা দেখিয়ে তারা নিশ্চিন্ত করতে চেয়েছিলেন, ইউ পি এ সরকার আস্থাভোটে জিতে যাতে
নিউক্লিয় চুক্তি করতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করণীয় তারা তা করছেন।
প্রথম ইউ পি এ সরকারের আমলে মন্ত্রীসভার অদলবদলেও
যে আমেরিকার কতটা প্রভাব ছিল উইকিলিকস কেবল সেটাও দেখিয়ে দিয়েছিল। ৩০ জানুয়ারী
২০০৬ পাঠানো আমেরিকান দুতাবাসের কূটনীতিক ডেভিড সি মালফোর্ড এর কেবলবার্তা অনুসারে
দেখা যাচ্ছে তিনি লক্ষ্য রাখছেন ২০০৬ এর জানুয়ারীতে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী হিসেবে
মনমোহন সিং সরকার নিযুক্ত করছে (কেবল এর মতে) আমেরিকাপন্থী মুরলী দেওরাকে, সরিয়ে
দিচ্ছে মণি শঙ্কর আইয়ারকে, যিনি (কেবল এ) বর্ণিত হচ্ছেন ইরাণ পাইপলাইন এর উচ্চকিত
প্রস্তাবক হিসেবে। মালফোর্ড এও বলেছেন “দেওরা সহ সাংসদদের একটা বড় অংশ আমাদের
রণনৈতিক সমঝোতার সঙ্গে প্রকাশ্যেই যুক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে সাতজন ভারত আমেরিকা যৌথ
সংসদীয় মঞ্চের সদস্য”। মন্ত্রীসভার অদল বদল প্রসঙ্গে মালফোর্ড এই বলে উপসংহার
টানছেন, “ভারত এবং ইরাণে এটা আমেরিকার লক্ষ্যের সঙ্গে ভীষণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ” এবং
এটা মনমোহন সিং সরকারের “ভারত আমেরিকা সম্পর্কের দ্রুত অগ্রগতিকে নিশ্চিত করতে
দৃঢ়তার প্রমাণ”।
প্রকাশিত কেবলবার্তা যেমন দেখিয়ে দিয়েছে ভারতের
আর্থিক নীতির ওপর আমেরিকার নিবিড় নজরদারী ও নিয়ন্ত্রণ এর দিকটি, তেমনি প্রকাশ করেছে
ভারতের মন্ত্রীরা বিভিন্ন কর্পোরেশনকে কেমন সুবিধা পাইয়ে দিয়ে থাকেন সেই দিকটিও।
একটি কেবল বার্তায় আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিন্টন ভারতের
অর্থমন্ত্রী সম্পর্কে জানতে চাইছেন, “মুখার্জী (প্রণব) কোন শিল্প বা বাণিজ্য
গোষ্ঠীর কাছে দায়বদ্ধ এবং কাদের তিনি আর্থিক নীতির মাধ্যমে সুবিধা পাইয়ে দেবেন?’’
হিলারী ক্লিন্টনের কেবল এটাও দেখিয়ে দেয় মন্ত্রীদের থেকেও আমেরিকাপন্থী আর্থিক
নীতি রূপায়ণে আমেরিকার কাছে যিনি বেশি বিশ্বস্ত, তিনি হলেন যোজনা কমিশনের ডেপুটি
চেয়ারপার্সন মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর মতোই যিনি কিনা
আই এম এফ দ্বারা নিযুক্ত। হিলারী প্রশ্ন করেছেন, “মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়ার পরিবর্তে
মুখার্জীকে কেন অর্থমন্ত্রীর পদে বসানো হল?’’
উইকিলিকস এর কেবল বার্তা বা এন এস এ-র নজরদারির
ফাঁস করা তথ্যাবলী এটাই দেখিয়ে দেয় মার্কিনের যে কোনও পদক্ষেপ আসলে অন্য দেশের ওপর
আর্থিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত বা সামরিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার চূড়ান্ত লক্ষ্যেই
নিবেদিত। সেই লক্ষ্যেই সে যাবতীয় কার্যকলাপ চালায়। বিষয়টি দেশের শাসকদের অবশ্যই
জানা আছে, কিন্তু তারা তাদের ব্যক্তিস্বার্থে বা যে কর্পোরেট মহলের তারা প্রতিভূ
তাদের স্বার্থে গোপন করে চলার চেষ্টা করেন। কিন্তু উইকিলিকস বা স্নোডেন এর ফাঁস
করে দেওয়ার তথ্যাবলী তাদের সত্যের মুখোমুখি হতে বাধ্য করে এবং জনভিত্তি ধরে রাখার
জন্য তারা কিছু ওপর ওপর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন। সম্প্রতি ভারতীয় কূটনীতিক দেবযানী
খোবরাগাড়েকে আমেরিকায় গ্রেপ্তারী ও নগ্ন তল্লাসীর পর ভারত যে কিছুটা কড়া অবস্থান
নিতে বাধ্য হয়েছে তার পেছনে একদিকে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘জাতীয়তাবাদী’
সাজার চাপ যদি ক্রিয়াশীল থাকে, তবে অন্যদিকে অবশ্যই বিবেচ্য হয়েছে এন এস এ-র
নজরদারির ফাঁস হওয়া তথ্যাবলীর সূত্রে দুনিয়া জোড়া মার্কিন বিরোধী অবস্থান, যার
শরিক তার নিজের দেশের জনগণও।
শাসক দলের দিক থেকে যখন এই ধরণের সাম্রাজ্যবাদ
বিরোধী জনপ্রিয় আবহকে মোকাবিলা করার জন্য কিছু ওপর ওপর পদক্ষেপ নেবার দিকে এগোতে
হবে, যেমন ভারতে মার্কিন কূটনৈতিকদের বিশেষ ক্ষমতাগুলি বাতিল করা ইত্যাদি তখন আমাদের
অবশ্যই এই ধরণের ইস্যুকে কেন্দ্র করে উঠে আসা জনপ্রিয় মার্কিন বিরোধী আবহের মধ্যে
দাঁড়িয়ে কংগ্রেস বিজেপি সহ ভারতের শাসক শ্রেণির দল ও তাদের পরিচালিত সরকারগুলির
লাগাতার মার্কিন ঘনিষ্ঠ আর্থিক ও বিদেশ নীতি কীভাবে দেশের আর্থিক ও অন্যান্য
নিরাপত্তাগত স্বার্থকে বিঘ্নিত করছে তা তুলে ধরতে হবে। মার্কিন চাপে দেশের
ব্যাঙ্ক, বীমা, টেলিকম, খুচরো ব্যবসা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলির কীরকম বিলগ্নিকরণ
ঘটছে বা তাতে ঢালাও প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে দেশের মানুষের
জীবন জীবিকার স্বার্থের তোয়াক্কা না করে, তা সামনে আনতে হবে। ভারতের কেন্দ্রীয়
মন্ত্রী নির্বাচন বা সংসদে আস্থা ভোটের প্রশ্নেও মার্কিন লবির চাপ বা ভূমিকার
পাথুরে প্রমাণ গুলির কথা, যা উইকিলিকস এর ফাঁস করা কেবল বার্তা থেকে উঠে এসেছে,
সেসব তুলে ধরে কেবল কূটনৈতিক মর্যাদার প্রশ্নটির চর্চা নয়, মার্কিন আধিপত্যবাদের
স্বরূপটিকে অবশ্যই উন্মোচিত করতে হবে।
ক্রমশই নিউক্লিয় চুক্তি,যৌথ
সামরিক মহড়া সহ নানা বিষয়ে আমেরিকার রণনৈতিক পরিকল্পনার অঙ্গীভূত হয়ে পড়া শাসক
শক্তিকে তার নাগরিকদের স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে
ব্যাপক গণ আন্দোলনই। সাম্রাজ্যবাদ
প্রভাবিত আর্থিক নীতিমালার স্বরূপকে সামনে আনার পাশাপাশি নিউক্লিয় চুক্তি বা এন এস
এ-র নজরদারির মত ‘উচ্চ প্রযুক্তি’গত
বিষয়কে গণ আন্দোলনের বিষয় করে তোলার জন্য তার বিভিন্ন দিককে সহজবোধ্যভাবে জনগণের
কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। এ জন্য বিশেষজ্ঞ ও গণ আন্দোলনের কর্মীদের উপযুক্ত মেলবন্ধন
প্রয়োজন। আজকের পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বিজ্ঞান প্রযুক্তি জগতের অনেক জটিল
বিষয়কে আশ্রয় করেই হানা দেবে,
আর এই বিষয়গুলির মোকাবিলায়
জনগণকে সমাবেশিত করে তুলতে হলে তাদের এই বিপদগুলি সম্পর্কে পরিচিত করার দায়ভার বাম
গণতান্ত্রিক শক্তিকে, বিশেষভাবে কমিউনিস্ট কর্মীদের নিতে হবে।
নিজেদের নিয়মিত প্রশিক্ষিত করে তোলা ও তাকে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিক
কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই এই সমস্ত বিষয়ে ব্যাপক গণজাগরণ তৈরি করা সম্ভব।
টীকা –
১) এন এস এ – এন এস এ-র প্রতিষ্ঠা ১৯৫২ সালে। এটি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় গুপ্তচর সংস্থা। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অপেক্ষা
বহির্দেশীয় বিষয়ে নজরদারি চালানোই এর মূল কার্যক্রম। আমেরিকার টেলিযোগাযোগ ও
ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞরা এখানে কর্মরত। বিভিন্ন গুপ্তসংকেত উন্মোচনের কাজও এখানে হয়।
আমেরিকান সংসদের প্রতিনিধিদের এক বিশেষ কমিটি এর কার্যকলাপ দেখাশোনা করে।
২) জি সি এইচ কিউ – আমেরিকান সরকারের অধীনে এন এস
এ যে ধরণের কাজ করে, ব্রিটেনে সে কাজ করে জি সি এইচ কিউ। এই গুপ্তচর সংস্থা ১৯১৯
সালে তৈরি হলেও ১৯৮৩ সালের আগে সরকারীভাবে এর অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয় নি।
৩) এন এস এ গার্ডিয়ান ফাইল – এডওয়ার্ড স্নোডেন এন
এস এ-র প্রিজম প্রকল্প ও গোপন নজরদারি সংক্রান্ত সমস্ত ফাইল তুলে দেন গার্ডিয়ান
পত্রিকার হাতে। গার্ডিয়ান পত্রিকায় ৫ জুন ২০১৩ থেকে ধারাবাহিকভাবে গোপন নজরদারির
তথ্যাবলী বেরোতে শুরু করে এবং গোটা বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই
রিপোর্টগুলিই এই লেখার মূল আকর।
আগ্রহীরা এই লিংক থেকে রিপোর্টগুলি ধারাবাহিকভাবে
দেখতে পারেন
http://www.theguardian.com/world/the-nsa-files
No comments:
Post a Comment