সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে
নতুনভাবে বামপন্থী রাজনীতির এক উত্থান চোখে পড়ছে। গ্রীস, স্পেন, পর্তুগাল গ্রেট
ব্রিটেন সহ বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার হাজার শ্রমিকের মিছিল হচ্ছে, তাদের ধর্মঘটে
গোটা দেশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। আন্দোলনের ময়দান থেকে সাফল্যের ঢেউ আছড়ে পড়ছে
নির্বাচনী রাজনীতির আঙিনাতেও। কয়েকটি দেশে বামপন্থীরা এর মধ্যেই ক্ষমতায় এসেছেন,
স্পেনের মত কোথাও কোথাও আসন্ন নির্বাচনে তাদের ক্ষমতায় আসার বিপুল সম্ভাবনা তৈরি
হয়েছে। ইতোমধ্যেই স্থানীয় নির্বাচনে তারা বিপুল জয় পেয়েছেন। বদল আসছে সমাজ
গণতন্ত্রে অভ্যস্ত হয়ে পড়া একদা বাম বিরোধী দলগুলির মধ্যেও, যেমন ব্রিটেনের লেবার
পার্টিতে। সেই বদল আবার গোটা দেশের রাজনীতির মানচিত্রকে বদলে দিতে চাইছে। এই লেখায়
আমরা ইউরোপ জুড়ে বামেদের এই নয়া উত্থানের কাহিনী ও তার প্রেক্ষাপটকে বুঝে নিতে
চাইব। সেইসঙ্গে এটাও লক্ষ্য করতে চাইবো এই বাম রাজনীতির একটা নতুন ভাষা আছে। নতুন
সাংগঠনিক রীতিনীতি আছে। পুরনো ধাঁচের সোভিয়েত সমাজবাদের প্রচলিত সংগঠন নীতির বাইরে
সংগঠন ভাবনার এক ভিন্ন গণতান্ত্রিক পরিসর তারা তৈরি করে দিয়েছেন, যা নিয়ে আমাদের
দেশ সহ পৃথিবীর সর্বত্রই বামপন্থী মহলে চর্চা অত্যন্ত জরুরী।
গত এক দশক জুড়েই ইউরোপ আমেরিকার
গোটা অর্থনীতি যেন থমকে আছে- ধ্বস এড়ানো গেলেও ব্যবসা ও অর্থনীতিকে স্লথ গতি থেকে
বের করা যাচ্ছে না, লাখ লাখ ছাটাই
হওয়া শ্রমিকের জন্য কর্মসংস্থানেরও কোন ব্যবস্থা হচ্ছে না। জনগণের করের টাকায়
ব্যক্তিপুঁজির বেল আউটের নীতির মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট কিছুটা সামলানোর পর
জুলাই ২০১১ থেকে আবার পতনের দিকে যাত্রা শুরু করে মার্কিন অর্থনীতি। ইউরোপের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে একেবারেই ব্যর্থ
হয়।
কেন এই ব্যর্থতা? মার্কস
বলেছিলেন পুঁজিবাদের মধ্যেই লুকানো আছে তার সঙ্কট। অতি উৎপাদনের সঙ্কট। পুঁজিবাদ
একদিকে যেমন মুনাফার তাগিদে তার উৎপাদন বাড়িয়ে যায় তেমনি অন্যদিকে শ্রমিকের মজুরি
কমিয়ে, শিক্ষা স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যয় কমিয়ে বাজারকে সঙ্কুচিত করে ফেলে। নিজের
তৈরি পণ্য নিজের নীতির কারণেই আর সে বেচতে পারে না। পুঁজিবাদ অতীতে নতুন
কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার বাজারকে প্রসারিত করে সঙ্কট থেকে
মুক্তির উপায় খুঁজেছিল, যেমন ১৯১৯ এ মহামন্দার সময় কেইনস এর নীতিমালা অনুসৃত
‘মার্শাল প্ল্যান’ এর মধ্য দিয়ে, এইবারের আর্থিক মন্দায় সেই প্রক্রিয়াটি ব্যবহার
করা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ৪৪৭
বিলিয়ন ডলারের নতুন একটা বিল উত্থাপন করেছিলেন ৭ সেপ্টম্বর ২০১১ তে। দুই দিন পর
নিউ ইয়র্ক টাইমস এর হেডলাইন হয়: “মালিকেরা
বলছেন নতুন কর্মসংস্থানের জোয়ার আসবে না”। মালিকেরা বলছে
তারা নতুন নিয়োগ দেবে না কারণ বাজারে বাড়তি পণ্যের চাহিদা বা জনগণের পর্যাপ্ত
ক্রয়ক্ষমতা নেই ফলে বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগও নেই। কিন্তু মুশকিল হলো নতুন
কর্মসংস্থান না হলে তো লোকের ক্রয় ক্ষমতাও বাড়বে না, বাজারের
চাহিদাও বাড়বে না! অন্যদিকে অতীতে আমরা দেখেছি এরকম সংকট জনক পরিস্থিতি সামাল
দেয়ার জন্য লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুজতে আমেরিকা ইউরোপ সহ প্রথম বিশ্বের
দেশগুলির লগ্নী পুজি সারা দুনিয়াকে তার বিনিয়োগের ক্ষেত্র বানিয়েছে। একসময় এভাবে
প্রান্তস্থ দেশগুলো থেকে, যেখানে পুজিবাদ তুলনামূলক কম
বিকশিত ফলে পুজিবাদের সংকটও অপরিণত, সেখানে পুজি রপ্তানির
মাধ্যমে বিপুল মুনাফা আহরণ করেছে আমেরিকা ইউরোপ এবং তার বিনিময়ে নিজ দেশের
অর্থনৈতিক সংকট ও শ্রেণী সংগ্রামকে সামাল দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ব্শ্বিায়িত
দুনিয়ায় ইতোমধ্যেই সারা দুনিয়ার প্রায় সমস্ত লাভজনক ক্ষেত্রে পুজিবাদী অর্থনীতির
নিয়মের আওতায় চলে আসা, নতুন বৈশ্বিক শ্রম বিভাজন, ম্যানুফ্যাকচারিং এর লাভজনক আউট সোর্সিং ইত্যাদির ফলাফল স্বরূপ পুজি
রপ্তানি এখন সাম্রাজ্যবাদী দেশের শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা উন্নয়ণের বদলে মজুরী হ্রাস,
শ্রমিক ছাটাই, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয়
হ্রাস ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আর এর ফলে
ইউরোপের আর্থিক সঙ্কট ক্রমেই শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক সঙ্কটে রূপান্তরিত হচ্ছে।
বিভিন্ন দেশের জাতীয় ঋণ লাগামছাড়া মাত্রায় পৌঁছনোর পর কীভাবে তার মোকাবিলা করা যায়
তা নিয়ে বিতর্ক সমাজ জীবনকে উথাল পাথাল করে দিচ্ছে। জার্মানীর চান্সেলর মার্কেল এর
নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী শিবির আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলার জন্য কড়া ব্যয়সঙ্কোচ নীতি
গ্রহণের দাওয়াই দিচ্ছেন, সরকারগুলিকে বেল আউটের (ঋণ মুক্তির) শর্ত হিসেবে
ব্যয়সঙ্কোচ নীতি গ্রহণে বাধ্য করছেন। বামপন্থী শিবির এই ব্যয়সঙ্কোচ নীতি, অর্থাৎ
স্বাস্থ্য শিক্ষা ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক খাতের অর্থবরাদ্দ হ্রাসের তীব্র বিরোধি।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে ব্যয়সঙ্কোচের এই বোঝা সাধারণের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠবে এবং
বাজার সঙ্কুচিত হয়ে সঙ্কটকে আরো তীব্র করবে, এই তাদের মত। উচ্চ আয়ের মানুষের করহার
বাড়িয়ে সেই অর্থে নতুন নিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে তারা এই সঙ্কটের
মোকাবিলা করার কথা বলছেন। দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী শিবিরের এই মত বিভাজন স্পষ্ট
চেহারা নিয়েছে এবং বিভিন্ন নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটছে। গ্রীসে বহু বছর পর এই
দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতেই বামপন্থীদের প্রবল সামাজিক ভিত সম্পন্ন গুরূত্বপূর্ণ শক্তি
হয়ে উঠতে দেখেছি। ২০১৫ র সাম্প্রতিক নির্বাচনে যারা কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসীন হতে
পেরেছেন।
সঙ্কটে পড়া
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মতো গ্রীসও এই নীতি এতাবৎ অনুসরণ করে এসেছে, যার
প্রতিক্রিয়ায় সিরিজার মতো র্যাডিক্যাল বামপন্থীদের উত্থান ও ক্ষমতা দখল। অবশ্যই
গ্রীস এবং সিরিজা একক ব্যতিক্রম কিছু নয়। স্পেন, ইতালি, পর্তুগাল সহ ইউরোপ এর
বিভিন্ন দেশেই র্যাডিক্যাল বামপন্থাকে আমরা উঠে আসতে দেখছি। নির্বাচনে বামপন্থীরা
সাফল্য পাচ্ছেন। তার চেয়েও বড় কথা নির্বাচনের
আঙিনার বাইরেও জনগণের বিক্ষোভ ইউরোপকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
গ্রীসের
পরিস্থিতি ও সিরিজার উত্থান এর পাশাপাশি স্পেন ও পর্তুগালে র্যাডিক্যাল বামপন্থা
ও শ্রমিক শ্রেণির এই নয়া জাগরণ চোখে পড়ার মতো। আগামী দিনে শ্রমিক শ্রেণি ও তার
রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা কমেই
বাড়ছে। তারা রাজনীতির পরিসরকে নতুন ভাবে খুলে দিতে পারছেন সাধারণ ও মেহনতি মানুষের
পক্ষে।
গ্রীস
গ্রীস ও
তার বর্তমান রাজনীতি অর্থনীতি সারা বিশ্বের চিন্তাজগতের কাছেই অন্যতম আলোচ্য বিষয়।
বহু দৃষ্টিকোণ থেকে সমকালীন গ্রীস নিয়ে আজকে চর্চা হচ্ছে। আমাদের এই সময়ের বিশিষ্ট
চিন্তাবিদ, রাজনীতির ভাষ্যকার বা অর্থশাস্ত্রীদের অনেকেই এই নিয়ে মননশীল আলোকপাত
করেছেন। পরিস্থিতি প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যা ও সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত
করছে। প্রস্তাব, প্রতিপ্রস্তাব, আপোষরফা, সফল ও নিস্ফল নানা বৈঠকের বিচিত্র চক্রের
মধ্য দিয়ে ঘটনাচক্র এগিয়ে চলেছে।
গ্রীসের
মধ্যে এবং বাইরে এই যে বিপুল আলোড়ন তাকে একটি বাক্যে গ্রীস গণভোটের আগে ধরতে
চেয়েছিলেন তার প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাস। ‘এই আলোড়নের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে
ব্যয়সঙ্কোচ এবং সমৃদ্ধির নীতির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব’, ‘কনট্রাডিকশন বিটুইন অস্টারিটি
অ্যান্ড প্রস্পারিটি’। গ্রীসের জনগণকে আহ্বান করেছিলেন ব্যয়সঙ্কোচ নীতির পক্ষে বা
বিপক্ষে এক খোলা গণভোটে এবং কথা দিয়েছিলেন ব্যক্তিগত অভীপ্সা নিরপেক্ষভাবে তিনি
জনগণের রায় মেনে পরবর্তী পদক্ষেপ করবেন। গ্রীস ৫ জুলাই গণভোটের রায়ে জানিয়ে দিয়েছে
তারা ব্যয়সঙ্কোচ নীতি চায় না। বস্তুতপক্ষে সিপ্রাস যে শাসক জোটের প্রতিনিধি হিসেবে
প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেছেন এই বছরে, র্যাডিক্যাল বামপন্থীদের সেই মঞ্চ সিরিজার
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিই ছিল দীর্ঘদিন ধরে চলমান গ্রীস সরকারের ব্যয়সঙ্কোচ নীতির
রদবদল এবং জনগণের সমৃদ্ধিকে চলমান ঋণসংকটের প্রেক্ষিতে চাপিয়ে দেওয়া নীতির ওপরে
স্থান দেওয়া।
গ্রীসের আলোড়নকে বুঝতে গেলে আমাদের
অবশ্যই তাকাতে হবে গ্রীস তথা ইউরোপ আমেরিকার আর্থিক সঙ্কটের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির
দিকে। সাম্প্রতিককালে প্রথমে আমেরিকায় ও পরে ইউরোপে যে আর্থিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে
তাতে বড় ভূমিকা থেকেছে একটা ফাটকা বুদবুদের বিস্ফোরণের, যা হাউজিং বাবল বিস্ফোরণ
নামে খ্যাত। আমেরিকার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি সরকারগুলো ঘরবাড়ির বাজারকে করছাড়
ইত্যাদি দিয়ে ফুলিয়ে তুলেছে, ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা আছে কিনা তা না দেখেই ঋণ দেওয়া
হয়েছে। ঝুঁকি বেড়েছে, বেড়ে যাওয়া ঝুঁকিকে মিলিয়ে তারা ডেরিভেটিভে পরিণত করেছে। ঋণ
পরিশোধের ক্ষমতা সীমার বাইরে যাওয়ার পর যাবতীয় ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ একসাথে অনাদায়ী হয়ে
পড়েছে, ব্যাঙ্কগুলোর পতনের সাথে সাথে সামগ্রিক অর্থনীতি সঙ্কটে পড়েছে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারী ঋণ
অত্যন্ত বেড়ে যাওয়াটাকেই সাম্প্রতিক ইউরো জোন ক্রাইসিস বলা হচ্ছে। দেশের মোট জাতীয়
উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় এটা এত বেড়ে গেছে যে তা অপরিশোধ্য জায়গায় চলে গেছে।
জিডিপির তুলনায় গ্রীসের ঋণ ১৬০ শতাংশ, আইসল্যাণ্ডে ১২৩ শতাংশ, ইতালিতে ১১৯ শতাংশ,
আয়ারল্যান্ডে ৯৫ শতাংশ, পোর্তুগালে ৯৩ শতাংশ, জার্মানি ও ফ্রান্সে ৮৩ শতাংশ করে,
স্পেনে ৬০ শতাংশর আশেপাশে গত পাঁচ ছয় বছরে ঘোরাফেরা করছে। [সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিসংখ্যানে স্বাভাবিকভাবেই
অল্পবিস্তর বদল ঘটছে।]
বিভিন্ন
বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, বিশেষত ব্যাঙ্ক ও ফাটকা পুঁজির কারবারীরা ঝুঁকি নিয়ে যে
সঙ্কট ডেকে এনেছে তা থেকে মুক্তি দিতে সরকার বেল আউট প্যাকেজ ঘোষণা করে। বিপুল বেল
আউট প্যাকেজের ফলে বাজেট ঘাটতি দেখা যায়। ২০০৭ এ ই ইউ দেশগুলির যে গড় বাজেট ঘাটতি
ছিল ০.৬ শতাংশ, তা আর্থিক সঙ্কটের পর দাঁড়ায় ৭ শতাংশ তে। গড় সরকারী ঋণ জিডিপির ৬৬
শতাংশ থেকে বেড়ে ৮৪ শতাংশ হয়। এই আর্থিক সঙ্কটের প্রেক্ষিতে ইউরোপের শাসক দলগুলি
ব্যয় সঙ্কোচের নীতি নেয়। এর দুটি দিক – ১) মানুষের ওপর সরকারের বেশি বেশি কর
চাপানো, ২) বিভিন্ন সরকারী ব্যয়বরাদ্দ কমানো, ভরতুকি
কমানো বা বন্ধ করা। এর ভিত্তিতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপক সামাজিক প্রতিক্রিয়া হয়।
বিভিন্ন দেশেই বেকারত্মের হার লাগামছাড়া চেহারা নেয়।
সিরিজা ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত
গ্রীসের সরকার তার জনগণের সুবিধা না দেখে ঋণ সঙ্কটের মোকাবিলায় জার্মানী ও
ফ্রান্সের নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপিয়ে দেওয়া নীতিমালার দাসত্ব করে গেছে।
২০০৯ সালে গ্রীসের ঋণ সংকট বড় আকারে সামনে আসে। দেখা যায় ঋণগ্রস্থতার পরিমাণ জাতীয়
আয় বা জিডিপির ১১২ শতাংশ হয়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ক্রেডিট রেটিং
সংস্থাগুলি গ্রীসের ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন করতে থাকে। জার্মানীর নেতৃত্বাধীন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আই এম এফ এর মতো ঋণদানকারী সংস্থাগুলি অর্থনীতির পুনর্গঠনের
জন্য চাপ বাড়াতে থাকে। আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলায় গ্রীসকে কয়েক দফায় ঋণ দেওয়া হয়,
কিন্তু প্রতিবারই তার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয় বাধ্যতামূলকভাবে জনগণের করবৃদ্ধি ও
বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস করার কঠোর শর্তাবলী, যা ‘কৃচ্ছসাধন
নীতিমালা’ (অস্টারিটি মেজারস) হিসেবে পরিচিত হয়।
২০১০ এর ১ মে জার্মানীর চাপে গ্রীস
এর সরকার প্রথমবারের জন্য ‘কৃচ্ছসাধন নীতিমালা’ ঘোষণা করে। এর বিনিময়ে পরদিন
ইউরোজন কর্তৃপক্ষ এবং আই এম এফ এর থেকে সে তিন বছরের মধ্যে ১১০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ
পাবার প্রতিশ্রুতি পায়। এর পর্বের পর্বটি শুরু হয় ২০১১ সালের জুলাই মাসে। ২১ জুলাই
ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতরে চলমান গ্রীক সঙ্কটের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন
দেশের নেতৃবৃন্দ সমন্বিত হয়ে গ্রীসের ঋণশোধের পর্বকে সাত বছর থেকে বাড়িয়ে পনেরো
বছর করতে সম্মত হন। সুদের হারও ৫.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেওয়া হয় ৩.৫ শতাংশে। ২৭
অক্টোবর ২০১১ তে ইউরো জোনের নেতারা এবং আই এম এফ পারস্পরিক সম্মতিক্রমে গ্রীসের
ঋণের কিছু অংশ মকুব করারও সিদ্ধান্ত নেন। এর সঙ্গে সঙ্গেই আসে কৃচ্ছসাধন নীতির
পরবর্তী পর্বের কঠোরতর শর্তাবলীও। ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমে আসে ঠিকই, কিন্তু তা আসে
ব্যাপকতর আর্থিক মন্দা, জাতীয় আয়ের সর্বাধিক ঋণাত্মক মাত্রা (-৭.১ শতাংশ), সর্বাধিক বেকারত্ম, শিক্ষা,
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মাত্রাছাড়া ব্যয়বাহুল্য ও অনিশ্চয়তা, ব্যাপক ছাঁটাই ও মজুরী
হ্রাস - ইত্যাদির বিনিময়ে। স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে বাড়তে থাকে প্রবল ক্ষোভ। ১৮ মে
২০১১ তে এক জনমত সমীক্ষায় দেখা যায় গ্রীসের জনগণের ৬২ শতাংশই ২০১০ এ আই এম এফ এর
নির্দেশে গ্রীসের কৃচ্ছসাধন নীতিতে সম্মতিদানকে বিরাট ভুল বলে মনে করেন। ৮০ শতাংশ
মানুষ মনে করেছিলেন অর্থমন্ত্রী পাপাকোন্সটান্টিনু সংকট সামলাতে চূড়ান্তভাবে
ব্যর্থ। ৯৭ শতাংশ মানুষ বেকারত্ম, ৯৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র এবং ৯২ শতাংশ মানুষ
ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কায় ভুগছিলেন।
গ্রীসের
রাস্তায় এর বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ব্যাপক বিক্ষোভ। ২০১৩ র ২০
ফেব্রুয়ারী গ্রীসে যে ধর্মঘট হয় তার ব্যাপকতা থেকেই জনগণের আশঙ্কা ও ক্ষোভের হদিশ
মেলে। মজুরি
ছাঁটাই ও করবৃদ্ধির যে রাস্তায় আর্থিক সঙ্কটে আবদ্ধ গ্রীস তার নিষ্কৃতির পথ খুঁজছে,
সাধারণ মানুষ তথা মজুরের পকেট কেটে ব্যাঙ্ক ও অতি ধনীদের স্বার্থ ও মুনাফা অক্ষুণ্ণ
রাখা হচ্ছে, এই ধর্মঘট সেই নীতির শ্রেণি চরিত্রকেই প্রশ্ন করেছিল। মিছিল সশব্দে শাসকদের সম্বোধন করেছিল ‘ডাকাত’ বলে। এটা
স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলার
যে পথ গ্রীস তথা ইউরোপের শাসক শ্রেণি নিয়েছে, জনগণ তা মেনে নিচ্ছে না। উল্লেখ্য এর কিছুদিন আগেই ২০১২ সালের ১৫ নভেম্বর স্পেন,
পর্তুগাল, ইতালি, গ্রীস, ফ্রান্স, বেলজিয়াম সহ প্রায় সমগ্র ইউরোপ প্রত্যক্ষ করেছিল
মহাদেশ জোড়া এক বিরাট মাপের প্রতিবাদী ধর্মঘট। তারপর আবারো গ্রীসের এই সফল ধর্মঘট ইঙ্গিত
দেয় নীতি পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী লড়াইতে শ্রমিক
শ্রেণির নাছোড় দৃঢ়তা গোটা সমাজের সমর্থন পাচ্ছে এবং ক্রমশ এই লড়াই আরো ব্যাপ্ত হচ্ছে।
ধর্মঘটের দিন এথেন্সের মিছিল থেকে গ্রীসের সরকারী শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ইল্লিওপাস
লিওপৌলোস রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই প্রত্যয়ই ব্যক্ত হয়েছে, যেখানে তিনি জানিয়েছেন,
‘এক সামাজিক বিস্ফোরণ অনতি ভবিষ্যতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে’।
এই সামাজিক বিস্ফোরণকে দেশের ভেতরের ও বাইরের
দক্ষিণপন্থী শক্তির প্রবল চেষ্টা স্বত্ত্বেও আটকানো যায় নি। এই সামাজিক আন্দোলনের
ঢেউয়ের ওপর দাঁড়িয়ে, জনগণের দাবিগুলিকে আত্মস্থ করে বিভিন্ন র্যাডিক্যাল
বামপন্থীদের জোট সিরিজা প্রথমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনে ব্যাপক নির্বাচনী
সাফল্য পায় এবং তারপর গ্রীসের জাতীয় নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে। ক্ষমতায় আসীন হয়ে
তারা ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও নিজেদের প্রতিশ্রুতি ও নীতিমালা থেকে সরে আসে
নি এবং ট্রোইকার (ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, আই এম এফ) চাপিয়ে
দেওয়া কৃচ্ছসাধন নীতিমালার উলটোপথে হেঁটে জনগণের সমৃদ্ধি ও সামাজিক ব্যয়বরাদ্দ
বৃদ্ধির দিকে মনযোগী হয়েছে। নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য ঋণশোধের ব্যাপক
চাপের সামনে তারা ‘কৃচ্ছসাধন নীতিমালা’ নিয়ে গণভোটে যায় এবং সেখান থেকে
কৃচ্ছসাধনের বিরোধী রায় নিয়ে নিজেদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে। ।
শুধুমাত্র র্যাডিক্যাল
বামপন্থী আলোড়ণের পুনর্জাগরণের দিক থেকেই নয়, ভূ রাজনৈতিক অবস্থান ভারসাম্যের কিছু
মৌলিক পরিবর্তনের সম্ভাবনাও এই সময় ব্যাপকভাবে চর্চিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক পশ্চাদ
অপসারণের পর্বটির আগে গ্রীসের সরকারের কঠোর অবস্থান এবং গ্রীক জনগণের গণভোটের রায়
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে গ্রীসের নিষ্ক্রমণের সম্ভাবনাকে সামনে আনে এবং এই সম্ভাবনা,
যাকে গ্রেক্সিট (গ্রীক এক্সিট) বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, শুধু রাজনৈতিক অবস্থান নয়,
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও আলোচিত হতে থাকে। বস্তুতপক্ষে ঋণ সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে
অতীতে অনেক দেশই নিজের মুদ্রার ইচ্ছাকৃত অবমূল্যায়নের মাধ্যমে রপ্তানী বান্ধব
পরিবেশ সৃষ্টি করে সঙ্কট মুক্তির চেষ্টা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকলে এবং মুদ্রা হিসেবে ‘ইউরো’ ব্যবহার করলে তার এই
সুবিধা নেই। তাই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান এর মতো অনেকেই গ্রীসকে ইউরোজন
ও ইউরো মুদ্রা ত্যাগ করে নিজস্ব মুদ্রা ‘দ্রাখমা’ চালু করার পরামর্শ দিয়েছেন।
[http://krugman.blogs.nytimes.com/2015/05/25/grexit-and-the-morning-after/?smid=tw-NytimesKrugman&seid=auto]
গ্রীস এই পথে যাত্রা করলে ইতালি পর্তুগাল বা স্পেনের মত
অনেক দেশই এই নির্গমনের পথ নিতে পারে বা কঠোরতর রফাসূত্র পেশ করতে পারে। ইউক্রেন
সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া অবশ্যই ইউরোপীয় অঞ্চলে নতুন মিত্র খুঁজে পেতে আগ্রহী
এবং গ্রীসের সঙ্গে ইতোমধ্যেই তার কিছু কথাবার্তা হয়েছে। এশিয়ায় চীনকে সঙ্গে নিয়ে
রাশিয়ার নতুন মঞ্চ গঠনের মধ্যেই ভূ রাজনীতির নতুন বিন্যাস থেমে থাকবে না এবং তা
সঙ্কটগ্রস্থ ইউরোপকে নানাভাবেই তাড়া করে যাবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে গ্রীসের নিষ্ক্রমণ অবশ্যই একমাত্র পথ
নয় এবং টমাস পিকেটির মত অনেক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদই ইতিহাসের সূত্র ধরে ঋণ সঙ্কট
মেটানোর ভিন্নতর সম্ভাবনার কথা বলেছেন।
[http://thewire.in/2015/07/08/thomas-piketty-germany-has-never-repaid-its-debts-it-has-no-right-to-lecture-greece/]
পিকেটি বলেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সার্বিক ঋণ
এর প্রশ্ন নিয়ে যেমন একটি বিশেষ সম্মেলন বসেছিল, তেমনি একটি সম্মেলন হওয়া দরকার।
শুধুমাত্র গ্রীস নয়, ইউরোপের আরো অনেক দেশের ঋণ সঙ্কট নিয়েই আলোচনা করার আছে। যে
জার্মানী ঋণ এর প্রশ্নে কড়া ও সুবিধাবাদী অবস্থান এখন নিচ্ছে, দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর তার বিপুল পরিমাণ ঋণ মকুবের কথাও পিকেটি এই প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে
দিয়েছেন। তাঁর চেতাবনী যদি গ্রীস বা অন্যান্য দেশের প্রতি ‘কৃচ্ছসাধন নীতিমালা’
গ্রহণের কঠোর অবস্থান বজায় রেখে তাদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে নির্গমনের রাস্তা পাকা
করে দেওয়া হয়, তবে ইউরোজোনের বিশ্বস্ততাই শুধু সমস্যায়িত হবে তাই নয়, ইউরোপের
সামাজিক বিন্যাস, তার গণতন্ত্র ও সভ্যতাই সঙ্কটগ্রস্থ হবে।
সমস্যা
অবশ্য গ্রীসের রাজনৈতিক মহলেও ভালোরকম বিদ্যমান এবং সংগ্রাম ও সমর্পণবাদী বিভিন্ন
প্রবণতার মিশেল সেখানে দেখা যাচ্ছে। ৫ জুলাই গ্রীসে গণভোটের মাধ্যমে ‘কৃচ্ছসাধন নীতি’ নিয়ে জনগণের রায় নেওয়া হয়েছিল।
৬১ শতাংশ মানুষ, নানা ভয়ভীতি প্রদর্শনকে উপেক্ষা করে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন ট্রোইকা
নির্দেশিত ‘কৃচ্ছসাধনের নীতিমালা’ মেনে নিতে তারা প্রস্তুত নন। এই গণভোটের রায় গ্রীসকে
অবশ্যই দরকষাকষির শক্ত জমির ওপরে দাঁড়
করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ঘটনার গতিধারা এর পরেও আবার অন্যদিকে নাটকীয় মোড় নিল। আমরা দেখলাম
ট্রোইকার নীতিমালার কাছে অনেকটা আত্মসমর্পণ করেই গ্রীসের সরকার নতুন অর্থসাহায্য নিলেন
এবং তা গ্রীসের পার্লামেন্টে গৃহীতও হয়ে গেল। এ যেন অনেকটাই ‘ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড টু
স্টেপ ব্যাক’ এর মতো ঘটনা। অবশ্য পরিস্থিতি এই আত্মসমর্পণের মধ্যেই থেমে থাকলো না এবং
আত্মগ্লানিতে সমৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস এর আবেগময় ভাষণও বিক্ষুব্ধদের শান্ত করতে
ব্যর্থ হল। গ্রীসের রাস্তায় আবারো শুরু হয়ে গেল তীব্র প্রতিবাদ, পার্লামেন্টের সামনে
মানুষ ফেটে পড়লেন তীব্র বিক্ষোভে। পার্লামেন্টের মধ্যেই অবশ্য অনেক সাংসদ এই নয়া আত্মসমর্পণের
বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন, যার মধ্যে শাসক জোট সিরিজার সাংসদরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সদ্য পদত্যাগ
করা অর্থমন্ত্রীও এই বিরুদ্ধতার শরিক। তাঁর একটি লেখায়
তিনি তুলে ধরলেন নয়া এই আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্র সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট আপত্তিগুলি।
[http://yanisvaroufakis.eu/2015/07/15/the-euro-summit-agreement-on-greece-annotated-by-yanis-varoufakis/]
কীভাবে গ্রীস নতুন করে আবারো শৃঙ্খলিত হতে চলেছে তাকে বিশ্লেষণ করে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যখন বিক্ষোভে সামিল, তখন শাসক
জোট সিরিজাও খোলা বিবৃতি দিয়ে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করল। সিরিজার কেন্দ্রীয়
কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। এই ঘটনা গ্রীসে
বর্তমান সরকারের স্থায়িত্ব ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েই নানা
প্রশ্ন তুলে দিল।নতুন করে নির্বাচন হল এবং সিরিজা
আবার তাতে বিজয়ী হল। এবার অবশ্য সেখানে আপোষের প্রবণতা অনেক বেশি। তবে তা সম্মিলিত
দক্ষিণপন্থার আক্রমণের মুখে বাধ্য হয়ে নেওয়া – এরকমটাই বলতে চাইছেন তার নেতৃত্ব।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শক্তিশালী বাম জাগরণ ও তাদের ক্ষমতায় আসা আবারো গ্রীসের
রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে বদলে দিতে পারে ।
গ্রীসে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আগামীদিনে কোন দিকে যাবে, সমর্পণ ও সংগ্রামের মধ্যকার
বিচিত্র দ্বন্দ্ব শেষপর্যন্ত কী পরিণতি পাবে, তার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতেই হবে।
কিন্তু গ্রীসের আর্থিক সঙ্কট ও তাকে সমাধানের পদ্ধতি ও নীতি সংক্রান্ত যে মৌলিক প্রশ্নগুলি
উঠে এসেছে তা ভিন্ন দেশকালের ব্যাপ্ত প্রেক্ষিতেও গুরূত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে।
স্পেনের রাজনীতিতে নয়া মোড় পোডোমস
স্প্যানিশ ভাষায় পোডেমস শব্দটির অর্থ ‘আমরা পারি’।
স্পেনের সাড়া জাগানো নতুন বামপন্থী দলটি এই নামেই আত্মপ্রকাশ করেছে এবং স্পেন তথা
ইউরোপের রাজনীতিতে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। তারা সামনে নিয়ে এসেছে কৃচ্ছসাধন
নীতিমালা বিরোধী একগুচ্ছ কার্যক্রম এবং তা জনসাধারণের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে।
গ্রীসে সিরিজার কাজকর্মকে, উত্থান ও বিকাশের সঙ্গে অনেকেই মিলিয়ে দেখতে চাইছেন
পোডেমস এর উত্থানকে এবং এই তুলনার বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। লাগামছাড়া জাতীয় ঋণের
প্রেক্ষিতে নেমে আসা আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলার নামে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া
কৃচ্ছসাধন নীতিমালার বিরুদ্ধে গ্রীসের সিরিজার মত স্পেনের পোডেমসও উচ্চকন্ঠ এবং
আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলায় তারাও ট্রাইকার (আই এম এফ, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপের
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক) নিদানের বিপ্রতীপে বিকল্প আর্থিক নীতিমালাকে সামনে এনেছে।
পোডেমসের জন্ম স্পেনে ২০১১ সালে শুরু হওয়া গণ
আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। ২০০৮ থেকে স্পেন তীব্র আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। তখন
হোসে লুই রডরিগেজ জাপাতেরোর নেতৃত্বাধীন ‘পি এস ও ই’ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন।
প্রথমদিকে আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলায় তারা কেইনসীয় নীতিমালাকে কিছুদূর পর্যন্ত অনুসরণ
করে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলা করতে চেয়েছিল।
কিন্তু ২০১০ সালের শেষদিক থেকে এক বিপরীত যাত্রা শুরু হয়। ট্রোইকার নিদান মেনে
কৃচ্ছসাধন নীতিমালা গ্রহণ করা হয়। ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিক কর্মচ্যূত হন এবং জনগণের
ক্ষোভ বিক্ষোভ বাড়তে থাকে। ২০১১ সালে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে রডরিগেজ পদত্যাগ করেন
এবং মারিয়ানো রাজয় এর নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী ‘পিপি’ দলটি ক্ষমতায় আসে। দ্রুতই
পেনশনের সুযোগ সুবিধায় নানাবিধ কাটছাট করা হয়। অবসরের বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা
হয়। কমিয়ে দেওয়া হয় সরকারী কর্মচারীদের মাইনে। স্বাস্থ্য বাজেটেও ব্যাপক কাটছাট
করা হয়। শিশু এবং বয়স্কদের জন্য প্রচলিত নানাবিধ প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়। মজুরী
দশ শতাংশ কমে যায়। বেকারত্মের হার ২৫ শতাংশে পৌঁছে যায়। ৫৫ লক্ষ বেকার কোনও
বেকারভাতা ছাড়াই কোনও রকমে বাঁচতে বাধ্য হয়। যাদের কাজ আছে তারাও নানা সঙ্কটের
মুখোমুখি হন। সিংহভাগ কাজই ঠিকা ধরণের প্রথায় রূপান্তরিত হয়।
স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম হয়।
ক্ষোভ বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকার ‘প্রতিবাদ বিরোধী’ চরম অগণতান্ত্রিক আইন পাশ করে।
প্রতিবাদ করলে শাস্তি হিসেবে বিরাট অঙ্কের জরিমানা ধার্য হয়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলির
ধর্মঘটের অধিকারের ওপর নেমে আসে আক্রমণ। অবশ্য আইনী ভ্রুকূটি দেখিয়ে গণ আন্দোলনকে
দমিয়ে রাখা যায় নি। স্পেনের শ্রমিক শ্রেণি এবং ব্যাপক জনসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে
নেমে আসেন প্রতিবাদ প্রতিরোধে। একের পর এক ধর্মঘট সংগঠিত হয়। স্পেনের শহর জুড়ে
প্রতিবাদী মিছিলে লক্ষ লক্ষ মানুষ সামিল হন।
২০১১ থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলনটি ১৫ মে থেকে শুরু
হওয়ায় এর জনপ্রিয় নাম হয়ে গেছে
‘এম-১৫’। ক্রমশই এই আন্দোলন নতুন গতি পায়। যাদের মুনাফার অতি লোভ ও অনৈতিক কার্যকলাপ আর্থিক সঙ্কটের
জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী সেই ব্যাঙ্কারদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থার দাবি এই
আন্দোলনে জোরালোভাবে ওঠে। অচিরেই অর্জিত হয় একদা আই এম এফ এবং পরে স্পেনের চতুর্থ
বৃহৎ ব্যাঙ্ক ‘ব্যাঙ্কিয়া’র প্রাক্তন কর্ণধার রডরিগো র্যাডোর বিরুদ্ধে ফৌজদারী
তদন্ত শুরুর নির্দেশ অর্জনের সাফল্য। উল্লেখযোগ্য রডরিগো ব্যাঙ্কের শীর্ষপদে থেকে
বহু মানুষের সর্বণাশ করেছিলেন। যদিও এই আন্দোলন এই ধরণের শীর্ষস্থানীয়দের
বিরুদ্ধেই শুধু নয়, গোটা ব্যবস্থাটারই বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। কেন এই আন্দোলন তা
ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতিবাদীদের এক সংগঠক, বছর পঁচিশেক বয়সের স্টেফানি গুয়েরসো
জানিয়েছেন, “ যেদিকে যাচ্ছিলাম, যা দেখছিলাম তা আমাদের ভালো লাগছিল না। আমরা অনুভব
করছিলাম আমরা আমাদের গণতন্ত্র হারাচ্ছি, আমাদের দেশকে হারাচ্ছি, আমাদের জীবন
ধারণের পথকে হারাচ্ছি। আমাদের একটাই স্লোগান, আমরা প্রকৃত গণতন্ত্র চাই”।
আন্দোলন চলাকালীন স্পেনের প্রধানমন্ত্রীর পার্লামেন্ট
ঘোষণা নিঃসন্দেহে বিক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। সরকারের ঘোষিত ব্যয়সংকোচ
কর্মসূচীতে ভ্যাট বাড়ানো থেকে শুরু করে ক্রিসমাসের বোনাস ছাঁটাই - কিছুই বাদ
যায়নি। প্রধানমন্ত্রী জানান,পণ্য ও পরিষেবাতে মূল্য সংযোজন
কর বা ভ্যাট তিন শতাংশ বাড়ানো হবে,ফলে স্পেনে ভ্যাটের নতুন হার
হবে একুশ শতাংশ। অনেক সরকারি কর্মচারী আর বড়দিনের বোনাস পাবেন না,আর দেশের
বিভিন্ন অঞ্চলেই সরকারি চাকুরেদের সংখ্যা বা বেতন ছাঁটাই করা হবে - কোনও কোনও
ক্ষেত্রে তা হবে এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। জনগণকে বলা হয় স্পেনের সঙ্কটাপন্ন
ব্যাঙ্কগুলোকে সাহায্য করার জন্য ইউরোজোনের নেতারা এক মাসের মধ্যেই তিন হাজার কোটি
ইউরো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন - তার শর্ত হিসেবে স্পেনকে নতুন একগুচ্ছ
ব্যয়সঙ্কোচনের প্রস্তাবে রাজি হতে হয়েছে। আর সেই শর্ত পূরণের তাগিদ থেকেই
প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয় পার্লামেন্টে এই সব নতুন পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করছেন।
এই পর্বে আন্দোলনের শুরুতে নগরের কেন্দ্রস্থল
পুয়ের্তো দেল সোল এ প্রথমে জমা হয়েছিলেন মাত্র জনা পঞ্চাশেক বিক্ষোভকারী। পুলিশ
বলপ্রয়োগে তাদের হটিয়ে দিতে চায়। এতে আন্দোলন তীব্র হয়। দিন তিনেকের মধ্যেই
স্পেনের অন্তত বারোটি শহরে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। প্রসঙ্গত
উল্লেখযোগ্য ২০১১ থেকে বিশ্বজোড়া অকুপাই আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্পেনের এই আন্দোলন
শুরু হলেও তা আমেরিকার মতো হঠাৎ গতি হারিয়ে ফেলেনি বরং নানা আকর্ষক পথে এগিয়ে
চলেছে। বিভিন্ন কর্মী দলে বিভক্ত হয়ে নানা ইস্যু ভিত্তিক লড়াইয়ে তারা অংশগ্রহণ
করছেন। রাজপথের আন্দোলনের সাথেই তারা মিলিয়ে নিয়েছেন আইনী লড়াইকেও। একটি দল বহু
মানুষের সর্বণাশকারী রডরিগো র্যাগোর মত ব্যাঙ্কারের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি লড়াইয়ের
পথে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় জনা পঞ্চাশেক আইনজীবী এগিয়ে আসেন বিনা পারিশ্রমিকে
মামলা লড়তে, মামলার অন্যান্য খরচ মেটানোর জন্য অজস্র মানুষের থেকে অল্প অল্প টাকা
নিয়ে একদিনেই ওঠে পঁচিশ হাজার ডলার। মামলা শুরু হয়। আর ব্যয়সঙ্কোচ নীতির ফাঁস যত
তীব্র অয়েছে, ততই বেড়েছে রাজপথে বিক্ষোভ। প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রোজার যখন
পার্লামেন্টে আরো বেশি কৃচ্ছসাধন নীতির কথা ঘোষণা করছেন, বলছেন বিক্রয়কর বাড়ানো বা
সরকারী কর্মচারীদের মজুরী কমানোর কথা, বেকারভাতার সময়সীমা কমিয়ে আনার কথা তখন
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার খনি শ্রমিক এসে পৌঁছন মাদ্রিদে। তাদের
স্লোগান ছিল ‘আমরা নিরানব্বই শতাংশ’। খনিশ্রমিকদের বক্তব্য,স্পেন সরকার যেহেতু কয়লাখনি
সংস্থাগুলোকে দেওয়া ভর্তুকির প্রায় দুই তৃতীয়াংশই ছাঁটাই করছে - তার ফলে এই খাতে
হাজার হাজার কর্মী চাকরি খোয়াবেন। শ্রমিকদের আন্দোলন বৃহত্তর
জনসমাজের সমর্থনলাভে সক্ষম হয়। টোনি নামে প্রতিবাদকারী একজন খনিশ্রমিক বলেন তারা
মাদ্রিদবাসীর কাছ থেকেও আশাতীত সমর্থন পেয়েছেন । “দারুণ সাড়াজাগানো সমাবেশ হয়েছে -
দেখুন, কত মানুষ এসেছেন! কেউ কেউ বলে মাদ্রিদ না কি দক্ষিণপন্থীদের শহর - কিন্তু
আমার তো তা মনে হয় না! এটা তো শ্রমজীবীদের শহর,সাচ্চা শহর। আমরা ভীষণই খুশি - গোটা
পদযাত্রায় আমরা দেশের প্রতিটা গ্রামে যেরকম সাড়া পেয়েছি মাদ্রিদেও তার কোনও
ব্যতিক্রম হয়নি ... সত্যিই এটা দারুণ ব্যাপার।”আগত খনি
শ্রমিক ও মাদ্রিদের নাগরিকদের বিপুল অংশ ব্যয়সংকোচ নীতির বিরুদ্ধে মিছিল করে
অগ্রসর হলে রবার বুলেট নিয়ে পুলিশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, অন্তত ছিয়াত্তর জন
গুরূতর যখম হন। কিন্তু দমন নীতি অগ্রাহ্য করে আন্দোলন ক্রমশ আরো তীব্র হয়। বড় ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশ করে সে দেশের প্রধান দু’টি ট্রেড ইউনিয়ন- ইউজিটি এবং
সিসিওও। সংগঠন দু’টি এ বিক্ষোভে অংশগ্রহণ
করার জন্য শ্রমিক শ্রেণি ছাড়াও দেশের সব নাগরিকের প্রতি আহ্বান
জানায়।
গণ আন্দোলনের এই উত্তুঙ্গ বাতাবরণেই পোডেমস এর জন্ম ও
বিকাশ। কৃচ্ছসাধন নীতিমালা বিরোধী গণ আন্দোলনকে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাস
বদলের আন্দোলনে রূপান্তরের ডাক দেয়। স্পেনের প্রচলিত দ্বিদলীয় রাজনৈতিক আধিপত্য,
যা দক্ষিণপন্থী পিপি ও সমাজগণতন্ত্রী পি এস ও ই- র মধ্যে বন্টিত ছিল, তা ভেঙে
দেওয়ার কথা বলে। রাজনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাসের পরিবর্তনের লক্ষ্যে তারা সুচিন্তিত
কর্মসূচী জনগণের সামনে হাজির করে। ২০১১ সালে লাগু করা বাজেট নীতি সংক্রান্ত
সংবিধানের ১৩৫ নং ধারাটি বাতিল করে ১২৮ নং ধারা যা রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তি মালিকানা
নিরপেক্ষভাবে দেশের সমস্ত সম্পদ জনকল্যাণে ব্যবহারের কথা বলে –তার সর্বাত্মক
ব্যবহারের পক্ষে পোডেমস উচ্চকিত প্রচার চালায়। পোডেমস এর বিকল্প প্রস্তাবগুলির
মধ্যে -
১) সরকারী ও ব্যক্তিগত ঋণের জনগণ কৃত হিসাব নিকাশ
২) সাপ্তাহিক কাজের সময় ৩৫ ঘন্টায় কমিয়ে আনা
৩) অবসরের বয়সকে ষাট এ নামিয়ে আনা
৪) মুনাফার জন্য গৃহীত লে অফ বা কর্মবিরতিকে
আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা
৫) দেশজুড়ে একটি ন্যূনতম রোজগারের সীমা নিরধারণ করা
৬) ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ওপর সংসদের নিয়ন্ত্রণ
তৈরি করা
৭) বেসরকারী ক্রেডিট রেটিং এজেন্সীগুলিকে নিষিদ্ধ
ঘোষণা করা ইত্যাদি অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় এবং এই কর্মসূচী অন্য
প্রধান দুটি দলের থেকে তাদের স্বকীয় অবস্থানকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে ।
২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসে নতুন দল হিসেবে পোডেমসের
যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মে মাসের নির্বাচনে রাজনীতির মঞ্চে নয়া
আবির্ভূত এই শক্তি সাড়ে বারো
লক্ষের বেশি ভোট পেয়ে সবাইকে চমকিত করে দেয়। অঙ্কের নিরিখে এটা প্রায় আট শতাংশ এবং
এই নির্বাচনে তারা পাঁচটি আসনে বিজয়ী হয়।
পোডেমস এর সাফল্যের পেছনে একটি গণ আন্দোলনকে রাজনৈতিক
পালাবদল এ রূপান্তরের ডাক দেওয়া ও নির্দিষ্ট কর্মসূচী হাজির করা যদি একটি
গুরূত্বপূর্ণ দিক হয়, তবে জোট রাজনীতি সংক্রান্ত নির্দিষ্ট অবস্থান অপর একটি
গুরূত্বপূর্ণ বিষয়। কমিউনিস্ট পার্টি অব স্পেন (পি সি ই) এর নেতৃত্বাধীন স্পেনের
বামপন্থীদের মঞ্চ ‘ইউনাইটেড লেফট’ এর সঙ্গে পোডোমস ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে এবং
একসময় এই মঞ্চের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হওয়া উচিৎ কিনা তাই নিয়ে দলের মধ্যে খোলামেলা
আলোচনা হয়। শেষপর্যন্ত পোডেমস তার স্বকীয়তার দিকে গুরূত্ব আরোপ করেই নির্বাচনী
রণকৌশল তৈরি করে। ‘ইউনাইটেড লেফট’ দের মঞ্চ যেহেতু নির্বাচনে পোডেমস এর প্রধান
প্রতিদ্বন্দ্বী ‘পিপলস পার্টি’ (পিপি)র সাথে এক্সট্রেমাদুরাতে জোট বেঁধে প্রাদেশিক
সরকার চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ইউনাইটেড লেফটদের সঙ্গে আবার পোডেমস এর অপর
প্রতিপক্ষ স্প্যানিশ সোশালিস্ট ওয়ার্কাস পার্টি (পি এস ও ই) র আন্দালুসিয়াতে
প্রাদেশিক স্তরে জোট ছিল, তাই পোডেমস নিজেদের স্বকীয়তাকে তুলে ধরার জন্য ইউনাইটেড
লেফটদের সঙ্গে নির্বাচনী দূরত্ব বজায় রাখে। কৃচ্ছসাধন নীতিমালার বিরুদ্ধে পূর্ণ
জেহাদ ও ভিন্নমার্গী রাজনৈতিক দর্শনকে জনগণের সামনে আনার জন্য পোডেমস এর এই রণকৌশল
সফল হয়। ২০১৫ সালের মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে পোডেমস সরাসরি অংশগ্রহণ না করে স্থানীয়
আন্দোলন এর সংগঠক ও নেতৃবৃন্দকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরা নির্বাচনে ভালোরকম
সাফল্যও অর্জন করে। ২০১৫ র শেষে স্পেনের সংসদীয় নির্বাচনে পোডেমস এর বিজয় সম্ভাবনা
স্পেনের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে
ফিনান্স ক্যাপিটাল এর রক্ষকেরা, ব্যাঙ্কিং এলিট, রুলিং এলিট এর সমন্বয় পোডেমস এর
মত শক্তিকে ঠেকাতে তৎপর থাকবে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে এবং কর্পোরেট মিডিয়াও তাদের
কব্জায় থেকে তাদের হয়েই কাজ করবে। গণ আন্দোলনের শক্তি এবং রুলিং এলিট এর
দ্বন্দ্বের স্পেনীয় সংস্করণ কীভাবে আত্মপ্রকাশ করে গোটা পৃথিবীর বাম গণতান্ত্রিক
মহল সেই দিকে আগ্রহী দৃষ্টি রাখছেন।
সংগঠন ভাবনার নতুন দিশা
বাম সংগঠনের নীতিমালা ও কর্মপদ্ধতির নিরিখেও পোডেমস
কিছু নতুন ধরণের চিন্তাভাবনাকে উশকে দিয়েছে। ভারত সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের
বামপন্থী চিন্তাবিদেরাই তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করবেন আশা করা যায়। আত্মপ্রকাশের পর
থেকেই পোডেমস এর সদস্যসংখ্যা ক্রমে বাড়ছে এবং তা দু লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। গোটা দেশের
হাজার খানেক পার্টিকেন্দ্রে এই সদস্যরা ছড়িয়ে আছেন এবং পার্টিকেন্দ্রগুলি সংগঠনের
উচ্চাবচ প্রচলিত কাঠামোর বদলে আনুভূমিক সমমর্যাদা নতুন ধরণের বামপন্থার মডেল
হিসেবেও ব্যাপক চর্চিত হচ্ছে। পোডেমস নিঃসন্দেহে বামপন্থী মতাদর্শকে তুলে ধরে
কিন্তু এই বামপন্থা সোভিয়েত ধাঁচের বামপন্থা থেকে ভিন্ন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে
পার্টি গঠন কাঠামোয় যেভাবে অঙ্গীভূত করে এক বিশিষ্ট পার্টি পরিচালন ব্যবস্থা গ্রহণ
করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে অভিনব ও আকর্ষক। পোডেমস গোটা স্পেন জুড়ে তৈরি করেছে
অসংখ্য পার্টি কেন্দ্র। পার্টিকেন্দ্রগুলিতে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক হয় এবং যে কেউ
সেই বিতর্ক তুলতে পারেন, বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে পারেন। প্রতিটি পার্টি কেন্দ্রে
একজন করে সাংগঠনিক নেতৃত্ব থাকেন এবং এই পদটি নিয়ম করে বিভিন্ন জনের মধ্যে বন্টিত
হয়। পার্টির অন্যতম মুখ ইগলেসিয়াস সহ অন্যান্যরা আছেন মাদ্রিদ পার্টি কেন্দ্রে।
কিন্তু গোটা দেশের পার্টিকেন্দ্রগুলির মাদ্রিদ পার্টিকেন্দ্রের সঙ্গে কোনও অধীনতার
সম্পর্ক নেই। বৈদ্যুতিন মাধ্যমকে ব্যবহার করে সাংগঠনিক নির্বাচন সম্পন্ন করা বা দ্রুত
বিভিন্ন প্রস্তাবকে প্রযুক্তিগত সুবিধা ব্যবহার করে সমস্ত পার্টিকেন্দ্রে পৌঁছে
দেওয়া নতুন ধরণের গণতান্ত্রিক পার্টি পরিচালন ব্যবস্থাকে সম্ভবপর করে তুলেছে।
সারা পৃথিবীতেই কমিউনিস্ট জমানার একদলীয় শাসন কাঠামোর
ফলিত দিকটির নানা সমস্যা রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার অন্যতম বিষয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন,
পূর্ব ইউরোপ এর কমিউনিস্ট জমানায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের অভাব, কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত
ইত্যাদি নিয়ে যে সব প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায়ই হয়ে থাকেন বিভিন্ন ঘরানার
বামপন্থীরা, বর্তমান জমানার চিন ও কিউবাকেও যার সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়া হয় – তার
মোকাবিলায় কি ধরণের গণতান্ত্রিক পার্টি/সংগঠন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন তা নিয়ে
সমগ্র বাম মহলেই পুনর্জাগরণের সম্ভাবনার এই সময়ে ব্যাপক চর্চা ও অনুশীলন প্রয়োজন।
স্পেনের পোডেমস সেই নিরিখেও বিশেষ গুরূত্বপূর্ণ এবং আগামী দিনে এই নিয়ে
স্বতন্ত্রভাবে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা জরুরী।
কৃচ্ছসাধন নীতিমালাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বামেদের জয় এবার পর্তুগালেও
গত ৪ঠা
অক্টোবর পর্তুগালে ২৩০ টি আসন বিশিষ্ট সংসদের নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে শাসন
ক্ষমতায় থাকা দক্ষিণপন্থী জোট এর দুই দল, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও পিপলস
পার্টি মোট ১০৭ টি আসন পায়। বিপরীতে বিরোধী বামপন্থী জোট; যার শরিক হল সোশ্যালিস্ট
পার্টি, ডেমোক্রেটিক ইউনিটি কোয়ালিশন (পর্তুগালের কমিউনিস্ট পার্টি ও গ্রীন
পার্টির মিলিত চেহারা) ও লেফট ব্লক;
মিলিতভাবে ১২২ টি আসন পায়।
বস্তুতপক্ষে
বিভিন্ন দেশের জাতীয় ঋণ লাগামছাড়া মাত্রায় পৌঁছনোর পর কীভাবে তার মোকাবিলা করা যায়
তা নিয়ে বিতর্ক বেশ কিছুদিন ধরেই ইউরোপের সমাজ জীবনকে উথাল পাথাল করে দিচ্ছে।
জার্মানীর চান্সেলর মার্কেল এর নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী শিবির আর্থিক সঙ্কট
মোকাবিলার জন্য কড়া ব্যয়সঙ্কোচ নীতি গ্রহণের দাওয়াই দিচ্ছেন, সরকারগুলিকে বেল
আউটের (ঋণ মুক্তির) শর্ত হিসেবে ব্যয়সঙ্কোচ নীতি গ্রহণে বাধ্য করছেন। বামপন্থী
শিবির এই ব্যয়সঙ্কোচ নীতি, অর্থাৎ স্বাস্থ্য শিক্ষা ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক খাতের
অর্থবরাদ্দ হ্রাসের তীব্র বিরোধী। অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে ব্যয়সঙ্কোচের এই বোঝা
সাধারণের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠবে এবং বাজার সঙ্কুচিত হয়ে সঙ্কটকে আরো তীব্র করবে, এই
তাদের মত। উচ্চ আয়ের মানুষের করহার বাড়িয়ে সেই অর্থে নতুন নিয়োগের মাধ্যমে
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে তারা এই সঙ্কটের মোকাবিলা করার কথা বলছেন। দক্ষিণপন্থী ও
বামপন্থী শিবিরের এই মত বিভাজন স্পষ্ট চেহারা নিয়েছে এবং গণ আন্দোলন থেকে শুরু করে
বিভিন্ন নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটছে।
পর্তুগাল এর দক্ষিণপন্থী জোটের শাসক সরকার
২০১২ সাল থেকেই তাদের কৃচ্ছসাধন নীতির বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদী আঁচ ভালোরকম টের
পেতে শুরু করে। ওই বছরেই রাজধানী লিসবনে প্রায় তিন লাখ শ্রমিক প্রতিবাদ মিছিলে অংশ
নিয়ে জানিয়ে দেন ব্যয়সংকোচ করা চলবে না। বস্তুতপক্ষে গত তিন দশকের মধ্যে এটিই ছিল
পর্তুগালে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ সমাবেশ। সমাবেশে অংশগ্রহণকারী বয়ন শ্রমিক সুশানা লিল
জার্মানী নির্দেশিত ব্যয়সঙ্কোচ নীতির বিরোধিতা করে বলেন, “আর্থিক সঙ্কট কেবল
জার্মানীকেই লাভবান করছে”। ওই বছরের মে মাসে পর্তুগালের সংসদ শ্রম আইনে যে সব
পরিবর্তন এনেছিল, পর্তুগালের প্রধান শ্রমিক ইউনিয়ন তার তীব্র বিরোধিতা করে।
তিরিশ বছর ধরে চলা স্বাস্থ্যনীতিতেও আসে পরিবর্তন।
বস্তুতপক্ষে ব্যয়বরাদ্দর তীব্রতম প্রকোপ পড়ে স্বাস্থ্যখাতেই। চিকিৎসক, নার্সদের
বেতনে কাটছাঁট করা হয়, বাড়ে ওষুধের দাম। অনেক সরকারী হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায়
চিকিৎসার সুযোগ পেতে রোগীদের অনেক বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। স্বাস্থ্যখাতে
ব্যয়বরাদ্দ হ্রাসের প্রতিবাদে চিকিৎসকেরা শুরু করেন ধর্মঘট। লিসবনের কেন্দ্রীয়
হাসপাতাল সাও হোসের চিকিৎসক ড. পিলার এবং ড. কার্লোস মার্টিং জানান দেশের
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারীকরণ সমাজে গভীর প্রভাব ফেলবে। মানুষ স্বল্পব্যয়ে
উন্নত চিকিৎসার যে সুযোগ পেতেন তা থেকে বঞ্চিত হবেন। বেসরকারীকরণের তাগিদে অনেক
সরকারী হাসপাতাল বন্ধও করে দেওয়া হয়। চিকিৎসা লাভজনক পণ্যে পরিণত হবার ফলে জনস্বাস্থ্য
বিঘ্নিত হতে থাকে। এসবের প্রতিবাদেই হয় এক ব্যাপক ধর্মঘট। সাধারণ মানুষ এই
ধর্মঘটকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করেন। এদেরই একজন দক্ষিণ লিসবনের আলমাদার এক ক্লিনিকে
চিকিৎসার জন্য আসা জনৈক জোয়াল পালমা ক্ষোভের সুরে জানিয়েছেন, “স্বাস্থ্য একটা ভালো
ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাকা আছে তো ঠিক আছে, না হলেই মরণ”।
বামপন্থীদের
এই বিজয় গত কয়েক বছরে পর্তুগাল জুড়ে শাসক জোট ও তার নেওয়া কৃচ্ছসাধন নীতিমালার
বিরুদ্ধে আছড়ে পড়া গণ আন্দোলন থেকেই উদ্ভূত। অবশ্য গণ আন্দোলনের থেকে উঠে আসা বামপন্থীদের এই বিজয়কে
শাসক শ্রেণি এখনো সহজে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। সমস্ত পক্ষকে হতবাক করে নির্বাচনী
গণ রায়কে অস্বীকার করে পর্তুগালের সাংবিধানিক প্রধান
রাষ্ট্রপতি অ্যানিবাল কাভাকো সিলভা বাম জোটের নেতা আন্তোনিও কোস্তাকে সরকার গঠনের
জন্য না ডেকে দক্ষিণপন্থী জোটের প্রধান ও বর্তমান শাসক পেদ্রো কোয়েলহোকেই সরকার
গঠনের জন্য ডেকেছেন। বামপন্থীদের স্পষ্ট বিজয় সত্ত্বেও কেন এই সিদ্ধান্ত তা
ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি যে বক্তব্য রেখেছেন তা শুধু পর্তুগাল নয় গোটা ইউরোপ
জুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছে। রাষ্ট্রপতি সিলভা বলেছেন লেফট ব্লক বা কমিউনিস্টরা সরকারে
এলে তা ব্রাসেলস এর ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর দপ্তরে বা লগ্নী(ফিনান্স) পুঁজির
কর্তাব্যক্তিদের কাছে খারাপ বার্তা পাঠাবে। তার চেয়ে ‘জাতীয় স্বার্থে’ দক্ষিণপন্থী
শক্তির সংখ্যালঘু সরকারও শ্রেয়। গত চলিশ বছরে পর্তুগালে কখোনোই ইউরোপীয় ইউনিয়ন
বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আসে নি এবং এবারও তাদের সে সুযোগ পাওয়া উচিৎ নয়। যারা লিসবন
চুক্তি, বিকাশ এবং স্থায়ীত্ব চুক্তি ভেঙে দেবার জন্য প্রচার করেছে, ইউরো মুদ্রার
বাইরে পর্তুগালের বেরিয়ে আসার কথা বলেছে, ন্যাটোর বাইরে বেরিয়ে আসার কথা বলেছে –
তাদের সরকারে স্থান দিতে না চেয়েই এই সিদ্ধান্ত বলে রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি
তার সাংবিধানিক ক্ষমতার বলে সংখ্যালঘু জোটের প্রধান পেদ্রো কোয়েলহো সরকার গঠনের
জন্য ডেকেও গণ রায়কে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারবেন না বলেই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা
মনে করছেন। নতুন সংসদ গঠনের পরেই পেদ্রো কোয়েলহোর সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা
প্রস্তাব আসবে এবং স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণপন্থী সরকারের পতন হবে বলে রাজনৈতিক
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বাম জোটের নেতা অ্যান্টোনিওনি কোস্তা রাষ্ট্রপতির এই
সিদ্ধান্তকে চরম ভুল মনে করে তীব্র হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন এর ফলে দেশে রাজনৈতিক
বিরোধিতার ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়বে। সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই অনাস্থা প্রস্তাব আনার
কথাও তিনি বলে রেখেছেন। আগামী দিনে পর্তুগালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড়
নেয় সেদিকে সবার চোখ থাকবে কিন্তু এটা এর মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে ইউরোপ জুড়ে শাসক
শ্রেণি আবার বামপন্থার ভূত দেখতে শুরু করেছে এবং যেন তেন প্রকারেণ তাকে আটকাতে
চাইছে। একসময় যে গণতন্ত্র সংক্রান্ত প্রশ্ন সে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে নিয়ম করে
তুলত আজ বামপন্থীদের আটকাতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে প্রকাশ্যে ভয়াবহভাবে দলন করতেও
সে যে পিছ পা নয়, পর্তুগালের নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে। তবে
এই প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইউরোপ জুড়ে গণ জাগরণ ও বাম উত্থানের গতিকে উল্টোদিকে
ঘোরানোর জন্য শাসক শ্রেণির নিরন্তর প্রচেষ্টা সফল হবে না এবং আরো নতুন নতুন সঙ্কটে
তাকে নিকট ভবিষ্যতে নিমজ্জিত হতে হবে।
বাঁক বদল ব্রিটেনেও
ব্রিটেনের
প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির দলনেতা নির্বাচিত হলেন জেরেমি কববিন এবং তাঁর
নির্বাচন লেবার নীতির এক বামপন্থী ঝোঁকের দিকে পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিৎ দিচ্ছে।
বস্তুতপক্ষে শুধু লেবার পার্টি বা ব্রিটেনের ক্ষেত্রেই নয়, ইউরোপের এক বিস্তীর্ণ
ভূখণ্ড জুড়েই আমরা নতুন চেহারায়, নতুন ভাষা ও আঙ্গিকে এক নতুন ধরণের সমাজতান্ত্রিক
চিন্তাধারার বিকাশ লক্ষ্য করছি। নির্বাচনের আঙিনায় এবং গণ আন্দোলনের বিস্তীর্ণ
প্রেক্ষাপটে এই নয়া জাগরণ গোটা বিশ্বের বাম গণতান্ত্রিক মানুষের কাছে অবশ্যই গভীর
আশা ও প্রত্যয়ের ব্যাপার।
রাশিয়া ও
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ধাঁচের সমাজবাদের পতনের পর গোটা বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্র গঠনের
কাজটি এক বড় ধাক্কার মুখে পড়েছিল। চিনও দ্রুত ‘চিনা ধাঁচের সমাজবাদের’ সঙ্গে বাজার
অর্থনীতি ও বড় পুঁজির সংযোগ তৈরি করছিল। ভারতের বুকে আমরা দেখছিলাম সবচেয়ে বেশি
গণভিত সম্পন্ন বাম দল সি পি আই (এম) ও তাদের পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি আন্দোলনের
হাতিয়ার হবার থেকে ক্রমশ উন্নয়নের হাতিয়ার ও (বুর্জোয়া) শিল্পায়নের রূপায়ণের দিকে
সরে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ধ্বনিত হচ্ছিল ইতিহাসের অবসান (এন্ড অব হিস্ট্রি) ও
পুঁজিবাদের বিকল্পহীনতার (দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ বা TINA) তত্ত্ব। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রতিহত প্রভাব একমেরু বিশ্বের বাতাবরণ ক্রমশ জোরদার করছিল।
অবশ্যই এই
একমেরু একনীতি বিশ্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে চাইছিল স্যাভেজের
ভেনেজুয়েলা, কাস্ত্রোর কিউবা এবং লাতিন আমেরিকার নানা দেশের গণ আন্দোলন ও বাম ঝোঁক
সম্পন্ন সরকারগুলির গঠন ও কার্যক্রম। কিন্তু পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পীঠ মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে একুশ শতকের প্রথম দশকের শেষের দিক থেকে শুরু হওয়া বিরাট
মন্দা গোটা পরিস্থিতির মাত্রাগত ও গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। আর্থিক মন্দা মার্কিন
রাজনৈতিক মানচিত্রের উপরি স্তরে রিপাবলিক্যান বা ডেমোক্র্যাট আধিপত্যের কোনও
পরিবর্তন সেভাবে সূচিত করতে না পারলেও শাসক শ্রেণির নীতির বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন
বা ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ এক বিকল্প নীতির আকাঙ্ক্ষা হিসেবে ভালোভাবেই সামনে আসে।
এই
আকাঙ্ক্ষা রাজনৈতিক কাঠামোর রূপ নিয়ে নেয় ইউরোপে এবং তা শক্তির ভারসাম্যেও
উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত করতে থাকে। শ্রমিক শ্রেণি নতুনভাবে আত্মঘোষণা শুরু
করে। মিছিল, সমাবেশ এবং ধর্মঘটগুলি বিভিন্ন দেশে সফলভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং লক্ষ
লক্ষ মানুষ তাতে সামিল হন। গণ আন্দোলন নিও লিবারাল অর্থনীতির নীতিমালা পরিবর্তনের
জোরালো দাবিসনদ পেশ করে এবং নির্বাচনী রাজনীতির ময়দানে ক্রমশ বেশি বেশি করে প্রভাব
বিস্তার করতে থাকে। এই
পরিপ্রেক্ষিতেই ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতৃত্বের নির্বাচনে দীর্ঘদিনের
সমাজতন্ত্রী নেতা জেরেমি করবিনের নির্বাচন বিশেষ তাৎপর্যের। এই জয়কে করবিন নিজে
বিজয়ের অব্যবহিত পরে ‘অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে জনগণের রায়’ বলে অভিহিত করেন।
ব্রিটেন ও বিশ্বের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা করবিনের এই জয়ের মধ্যে লেবার পার্টির সমাজ
গণতান্ত্রিক অভিমুখ থেকে পালাবদলের ইঙ্গিৎ খুঁজে পাচ্ছেন এবং তার নির্দিষ্ট কারণ
রয়েছে। উত্তর লন্ডনের তিন দশকের পার্লামেন্ট সদস্য করবিন বরাবরই সমাজবাদী
অর্থনীতির কথা সোচ্চারে বলে এসেছেন। যুদ্ধবিরোধী নীতিমালার সোচ্চার প্রচারক,
ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের সহায়ক নীতিমালার কড়া সমালোচক এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি
উদ্যোগের এক সংগঠক হিসেবেই মানুষ বরাবর তাকে চিনেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক
সঙ্কটের মোকাবিলায় কৃচ্ছসাধন নীতির এক কড়া সমালোচক হিসেবে তিনি দেশজুড়ে
প্রচারাভিযান চালিয়েছেন। করবিন জনকল্যাণমুলক অর্থনৈতিক কাজে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ
কাঁটছাটের যেমন তীব্র সমালোচনা করেছেন, তেমনি বিজয়ের পরেই ইরাক যুদ্ধে ব্রিটেনের
ভূমিকার জন্য বিশ্বের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। এসবের পাশাপাশি শরণার্থীদের তীব্র
সঙ্কটের মুখে ব্রিটেনে তাদের স্বাগত জানিয়ে তার রাজনৈতিক অভিমুখটি স্পষ্ট করে
দিয়েছেন।
কৃচ্ছসাধন নীতিমালার বিরুদ্ধে এবং তারই অঙ্গ হিসেবে
শ্রমিকের মজুরি ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা করবিন বলেছেন।
তার নির্বাচন ও রাজনৈতিক অভিমুখ স্পষ্ট হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে লেবার পার্টির দক্ষিণ
ঘেঁষা সমাজ গণতন্ত্রী নেতৃত্ব রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়েছেন এটা যেমন ব্রিটেনের
বিকাশমান ঘটনাবলীর একটা দিক, তেমনি অন্যদিকে এই নয়া নীতিমালার মধ্য দিয়ে দেশের
বৃহৎ ট্রেড ইউনিয়নগুলি আবার নতুন করে লেবার পার্টির সঙ্গে সমন্বিত হতে চাইছেন –
এটাও বিকাশমান রাজনৈতিক চালচিত্রের অন্য একটা দিক। ফ্রায়ার ব্রিগেড ইউনিয়ন বা আর
এম টি রেল ইউনিয়ন করবিনের নেতৃত্বের দিকে তাকিয়েই লেবার পার্টির সঙ্গে তাদের
পুন:সংযোগ স্থাপন করছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ব্রিটেনের অন্যতম শক্তিশালী ফ্রায়ার
ব্রিগেড ইউনিয়ন ২০০৪ সালেই ব্লেয়ার নীতিমালার প্রতি ক্ষোভবশত লেবার পার্টির সঙ্গে
সংযোগ পরিত্যাগ করেছিল।
বস্তুতপক্ষে লেবার পার্টির নেতা হিসেবে করবিনের নির্বাচিত
হওয়া একটি বিরাট সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে ব্রিটেন এবং ইউরোপের বুকে। একে এগিয়ে নিয়ে
যাওয়ার জন্য শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম এবং সৃজনশীল রাজনীতির প্রয়োজন হবে,
তা বলাই বাহুল্য। কারণ পলিটিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট এবং শাসক শ্রেণির তরফে, লেবার
পার্টির ভেতর ও বাইরে থেকে করবিন এবং বাম আন্দোলনের নয়া গতিকে রুদ্ধ করার সংগঠিত ও
ব্যাপ্ত প্রয়াস থাকবে। এই চ্যালেঞ্জ এবং তাকে মোকাবিলায় এতাবৎ গৃহীত করবিন ও
সঙ্গীদের উদ্যোগের পথরেখাটা বুঝে নেওয়া এই প্রসঙ্গে বিশেষ গুরূত্বপূর্ণ।
নির্বাচনের আগেই করবিনকে লেবার পার্টির প্রতিষ্ঠিত
নেতৃত্বের তরফে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। টনি ব্লেয়ার এবং গর্ডন
ব্রাউনের নেতৃত্বাধীন ‘নিউ লেবার’ জমানায় মূলত সমাজ গণতান্ত্রিক একটি দলে পরিণত
হয়ে যাওয়া লেবার পার্টিতে করবিনকে দেখা হচ্ছিল ‘পলিটিক্যাল মিসফিট’ হিসেবেই এবং
তার জয়ের সম্ভাবনাকে প্রথম দিকে তেমন গুরূত্বও দেওয়া হচ্ছিল না। কিন্তু করবিন তাঁর
প্রচারপর্বে যখন শ্রমিকশ্রেণির মজুরী ও অন্যান্য দাবিদাওয়ার পক্ষে এবং কৃচ্ছসাধন
নীতিমালার বিপক্ষে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যান, তখন পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু
করে। অনেক প্রতিষ্ঠিত লেবার নেতৃত্ব যেমন করবিনের বিরুদ্ধে চলে যান, তেমনি করবিন
করবিন পাশে পেয়ে যান জন ম্যাকডোনেল, অ্যাঞ্জেলা ইগেল, সাদিক খান, কেন লিভিংস্টোন
এর মতো একসারি প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন নেতৃত্বকে। জন ম্যাকডোনেল ট্রেড ইউনিয়নগুলির
সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক স্থাপনের কাজে বিশেষ ভূমিকা নেন এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলি তথা
শ্রমিক শ্রেণির বিপুল সমর্থনই করবিনের লেবার পার্টির নেতৃত্বে আসার পথ সুগম করে।
ইউনাইট এবং ইউনিশন – এই দুটি বড় শ্রমিক ইউনিয়নের সমর্থন করবিনের জয়ের রাস্তাকে
অনেকটাই সুগম করে দেয়। শাসক কনসার্ভেটিভ পার্টির ‘ওয়েলফেয়ার বিল’ এর বিরুদ্ধে তার
ভোটদান তাকে ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব হিসেবে সামনে আনে, কারণ অন্যরা ভোট দানে বিরত
থাকার পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন। যারা লেবার পার্টির দক্ষিণপন্থী ঝোঁকে হতাশ হয়ে
পার্টি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন করবিন তাদের দলে ফেরার ডাক দেন এবং নীতির মোড় ঘোরানোর
আন্দোলনে সামিল হবার কথা বলেন। করবিন তাঁর প্রচারাভিযানের অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও
ব্যাপক জনসংযোগ নীতি নেন। ৫ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ তিন ডলার করে অর্থ সাহায্য করেন
এবং করবিনের নীতিমালার প্রতি তাদের সমর্থন জানান। মানুষকে সমন্বিত করেই তাঁর
নির্বাচনী সাফল্য এসেছে যার মূল ভিত্তি শ্রমিক শ্রেণি। সাধারণ মানুষ এবং বিশেষভাবে
শ্রমিক শ্রেণির দাবি দাওয়ার আন্দোলনকে গোটা দেশে ছড়িয়ে দেবার মধ্য দিয়েই যে তিনি
এরপর এগোতে চাইবেন সেখানে কোনও অস্পষ্টতা নেই। লেবার পার্টি তথা ব্রিটেনের
রাজনীতিতে বাম ও শ্রমিক আন্দোলনের নয়া অধ্যায় করবিনকে কেন্দ্র করেই দানা বাঁধতে
চাইছে এবং নিশ্চিতভাবেই তা ইউরোপ জোড়া নয়া বাম রাজনৈতিক উন্মেষের এক সম্ভাবনাময়
অংশ। ব্রিটেনের ফ্রায়ার ব্রিগেড ইউনিয়নের নেতা ম্যাট র্যাক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “
গত তিরিশ বছর ধরে এই দেশে এবং গোটা ইউরোপে বামেরা হামলার মুখে ছিল। এখন বিদ্রোহের
অনেক স্ফুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। আমরা (ট্রেড ইউনিয়নগুলি) যদি করবিনের প্রচারের সঙ্গে
দৃঢ়ভাবে সমন্বিত হতে পারি, তবে আমরা এক বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলতে পারব”। করবিনের নেতৃত্বে
লেবার পার্টি এবং ব্রিটেনের শ্রমিক আন্দোলন কোন রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করতে
সক্ষম হয়, সেদিকে অবশ্যই আমাদের আগ্রহী চোখ থাকবে।
রাজনৈতিক অর্থনীতির ভাবনা বদল
‘কৃচ্ছসাধন’ এর যে নীতিমালার ওপর দাঁড়িয়ে
আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলা করার জন্য চাপ দিচ্ছে জার্মানীর নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় ইউনিয়নের
দক্ষিনপন্থী লবি, তার সারবত্তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন স্টিগলিজ, ক্রুগম্যান, পিকেটি, অমর্ত্য সেন সহ অনেক অর্থশাস্ত্রী। ইতিহাস
পর্যালোচনা করে তাঁরা দেখিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে না আর্থিক
না সামাজিক – কোনও দৃষ্টিকোণ থেকেই কৃচ্ছসাধনের নীতিমালা কার্যকরী হতে পারে নি। বরং
ব্যাপক ঋণ সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে ঋণের পুনর্বিন্যাসই সঙ্কটের প্রকৃত সমাধান বলে বিবেচিত
হয়েছে। অমর্ত্য সেন তাঁর সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে
[http://www.newstatesman.com/politics/2015/06/amartya-sen-economic-consequences-austerity]
দেখিয়েছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানীর
ওপরেও এরকমই এক ঋণের বোঝা চেপে বসেছিল। এবং প্রাচীন রোমক প্রথা অনুসারী এই শোষণ পদ্ধতিকে
অকার্যকরী বলেই মনে করেছিলেন সেকালের অন্যতম বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রী কেইনস। পিউনিক যুদ্ধে
পরাজয়ের পর কার্থেজের ওপর যেভাবে বিজয়ী রোম
আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ইংলন্ড ফ্রান্স ইতালি আমেরিকা
সহ বিজয়ী পক্ষ জার্মানীর ওপর একই রকম কাজ করতে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেছিলেন আর ভার্সাই
সন্ধি স্বাক্ষরের কয়েকদিন আগেই এর শর্তাবলী সম্পর্কে তীব্র ভিন্নমত পোষণ করে এ থেকে
সরে এসেছিলেন। বস্তুতপক্ষে এ নিয়ে কেইনস তাঁর যুক্তিমালা সহ লিখেছিলেন আস্ত একটি বই
– ‘ইকনমিক কনসিকোয়েন্স অব দ্য পিস’। জার্মানীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া কৃচ্ছসাধন নীতির বিপক্ষে
ছিলেন কেইনস এবং পরবর্তী ইতিহাস তাঁর দূরদৃষ্টির স্বাক্ষ্য দেবে। আজকে ইতিহাসের পক্ষ
বদল হয়ে জার্মানীর নেতৃত্বেই গ্রীসের ওপর কৃচ্ছসাধন নীতিমালা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
চলতে পারে, কিন্তু তাতে অর্থশাস্ত্রের সাধারণ নীতিমালা বদলে যায় না। একইভাবে মূলত লগ্নি
পুঁজির বাজারের চূড়ান্ত পর্যায়ের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল থেকেই (মার্কিন
ব্যাঙ্কগুলির পতনের মধ্য দিয়ে) সাম্প্রতিক সময়ে
ইউরোপ আমেরিকা জুড়ে যে আর্থিক সঙ্কটের সূত্রপাত, তার বাস্তবতাকে সরকারের ব্যয়সঙ্কোচ ও কৃচ্ছসাধন নীতি গ্রহণের উপদেশমূলক প্রচারের মধ্য দিয়ে ঢেকে দেওয়া যায় না। সেইসঙ্গে বিভিন্ন আর্থিক সমীক্ষা থেকে এটাও স্পষ্টভাবে বুঝে নেবার দরকার আছে কৃচ্ছসাধন নীতিমালা প্রকৃতপক্ষে আর্থিক সঙ্কটকেই আরো ঘনীভূত করে তুলছে এবং তা কোনোভাবেই জাতীয় আয় ও ঋণের অনুপাতের
অসামঞ্জস্যর সঙ্কটকে সমাধান করতে পারবে না। যদি খুব সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের সঙ্কটগ্রস্থ
দেশগুলির অবস্থা কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে থাকে, তবে তা হয়েছে তলা থেকে আন্দোলনের চাপে
‘কৃচ্ছসাধন নীতিমালা’র বিপরীতে অর্থনীতিকে কিছুটা প্রসারিত করার চেষ্টার মধ্য দিয়েই।
ক্লিন্টনের সময়ে আমেরিকা বা ১৯৯৪-৯৮ পর্বে সুইডেনের প্রবল সঙ্কটকে কৃচ্ছসাধনের মধ্য
দিয়ে নয়, জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই সামলানো সম্ভব হয়েছিল।
কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণার মধ্য থেকে
আর্থিক সঙ্কট ও তার সঙ্গে জড়িত সামাজিক সঙ্কটকে কীভাবে সামলানো যায় তার উদাহরণ হিসেবে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটেনের অর্থনীতির দিকে তাকানো যায়। বিশ শতকের চল্লিশের
দশক থেক ষাটের দশক পর্যন্ত ব্রিটিশ অর্থনীতির জাতীয় আয়ের চেয়ে জাতীয় ঋণের পরিমাণ অনেক
বেড়ে গিয়েছিল, এমনকী তা দুশো শতাংশও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেই সময় ব্রিটেনে কৃচ্ছসাধন নীতির
পরিবর্তে সরকারী উদ্যোগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিস্তার ঘটানো হয়, তৈরি হয় ‘ন্যাশানাল
হেলথ সার্ভিস’ এবং তা বিশেষ ফল দেয়। সামাজিক আর্তিকেই তা শুধু হ্রাস করেছিল তাই নয়,
অর্থনীতির বৃদ্ধির চাকা ঘোরাতেও সক্ষম হয়েছিল। আজ গ্রীস, পর্তুগাল, ইতালি, স্পেন সহ
ইউরোপের একগুচ্ছ দেশের বিশেষ আর্থিক সামাজিক সঙ্কটের সামনে
দাঁড়িয়ে চাপিয়ে দেওয়া কৃচ্ছসাধন নীতির পরিবর্তে জনগণের আর্তি ও প্রতিবাদের অন্তর্বস্তুর দিকে নীতি নির্ধারকদের নজর ঘোরানোর প্রয়োজন
আছে। জনগণের সামনেও সুযোগ আছে একচেটিয়া পুঁজির
মুনাফার পাহারাদারদের বিরুদ্ধে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ গড়ে তোলার। ইউরোপকে সত্যিই আজ
এক নতুন ভূত আবার তাড়া করছে। ১৮৪৮ এ প্রকাশিত ক্ষীণকায় ম্যানিফেস্টোর প্রথম
বাক্যটি নতুনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে চিন্তায়, রাস্তায়। ‘আ স্পেকট্রা ইজ হন্টিং ইউরোপ’
...
No comments:
Post a Comment